প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "বার্লিন কংগ্রেসের সমালোচনামূলক আলোচনা করো" -এই প্রশ্নটি।
বার্লিন কংগ্রেসের সমালোচনা -
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দকে অবদমিত জাতীয়তাবাদের সাফল্যের বছর হিসাবে অভিহিত করা হয়। এই সময় জাতীয়তাবাদের কারণে ইতালি এবং জার্মানির মধ্যে ঐক্য সম্পন্ন হয়। যে জাতীয়তাবাদ ইতালি এবং জার্মানির মানুষদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার ঘটিয়েছিল এবং তাদের শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরনা জাগিয়েছিল সেই জাতীয়তাবাদ-ই তুরস্ক সাম্রাজ্যের বলকান জনগণের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক আদর্শ হিসাবে কাজ করেছিল। এই সময় বলকান অঞ্চলে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠতে থাকে এবং বসনিয়া-হার্জিগোভিনা ও বুলগেরিয়া অঞ্চল হয়ে ওঠে তুরস্কের জাতীয়তাবাদের প্রধান কেন্দ্রস্থল। রাশিয়া শ্লাভদের অঞ্চলগুলিকে নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হওয়ায় তুরস্কের ভাগ্য ক্রমশ জটিলতার দিকে এগিয়ে যায়।
তুরস্কের ঘটনা এবং রাশিয়ার আক্রমণ ঃ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে হার্জিগোভিনার কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ম্যাসিডেনিয়া, বুলগেরিয়াও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। বুলগেরিয়া প্রায় ১০০ জন তুর্কিকে হত্যা করে ফলে কনস্টান্টিনোপলের তুর্কি শাসক বুলগেরিয়ার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এরপরই তুরস্ক সরকার বুলগেরিয়াতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় যা সমগ্র ইউরোপে একটি আলোড়ন ফেলে দেয়। এরপর তুরস্ক সার্বিয়াকেও হারিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় সার্বিয়া বড়ো রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করলে তার পাশে রাশিয়া এগিয়ে আসে এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাশিয়া তুরস্ককে পরাজিত করে এবং ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সানস্টিফানোর সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। এই সন্ধির ফলে তুরস্কতে রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপন সহজ হয় এবং রাশিয়ার এই সাফল্যের ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি ঈর্ষান্বিত হয়।
বার্লিনের চুক্তি ঃ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হওয়া বার্লিনের চুক্তিতে অংশ নেয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র। এই চুক্তিতে বিসমার্ক সাধু দালাল বা "Honest Broker" এর ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বার্লিন চুক্তির ধারা ঃ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত বার্লিন সম্মেলনের কিছু ধারা গৃহীত হয়। যেমন -
প্রথমত ঃ এই চুক্তির ফলে রাশিয়া একটি ধাক্কা খায় কিন্তু রাশিয়া কার্ম, বাটুম, বেসারারিয়া, আর্মেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চল নিজের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বুলগেরিয়াকে দুভাগে ভাগ করা হলে সর্ব শ্লাভদের আন্দোলন আধাতপ্রাপ্ত হয়। এই চুক্তির ফলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের অধিকার পায়, এর ফলে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
দ্বিতীয়ত ঃ বসনিয়া এবং হার্জিগোভিনা অস্ট্রিয়ার দখলে পড়ে। কিন্তু এর থেকেও অস্ট্রিয়ার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জার্মানির বন্ধুত্ব লাভ। বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে সাহায্য করেছিল এবং ভবিষ্যতে ত্রি-শক্তি মৈত্রী স্থাপনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
তৃতীয়ত ঃ তবে বার্লিন চুক্তির ফলে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তুরস্ক। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের প্যারিসের চুক্তি অনুসারে তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে কিন্তু ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের বার্লিন সম্মেলনে বৃহৎ শক্তিবর্গ এই প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করেছিল। ফলে তুরস্কের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
চতুর্থত ঃ ব্রিটেনের দাবী ছিল, বার্লিন চুক্তির ফলে ইংল্যান্ড সবথেকে বেশি লাভবান হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলী ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সম্মানের সাথে শান্তি আনতে পেরেছেন। তবে এই দাবী নিরর্থক বা অমূলক। অচিরেই তুরস্ক ইংল্যান্ড সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির সাথে যোগদান করলে, ডিজরেলী দাবী করেন তুরস্ক আবার ইউরোপে ফিরে এসেছে। এর থেকে এটা স্পষ্টত যে, ইংল্যান্ডের তুরস্ক নীতি ভুল ছিল।
মূল্যায়ন ঃ প্রকৃতপক্ষে বার্লিন কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ ফলাফলের চেয়ে পরোক্ষ ফল গুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বার্লিন চুক্তির পর ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে এবং অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব, অস্ট্রিয়া-বুলগেরিয়া দ্বন্দ্ব, সার্বিয়া-বুলগেরিয়া দ্বন্দ্ব প্রভৃতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে তোলে। ফলে ইউরোপে নতুন করে ক্ষমতা ভারসাম্যের সূচনা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের বার্লিন চুক্তি পরোক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য একাংশে দায়ী ছিল।