বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ

আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণ" (The reason for the decline of Buddhism) -প্রশ্নটি নিয়ে। 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে ৬৩ টি প্রতিবাদী ধর্মমত গড়ে উঠতে দেখা যায়। যার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্মমত ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য আরও অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কয়েকশত বছরের মধ্যেই ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম অবলুপ্তির পথে পা বাড়ায়। বিভিন্ন কারণে বৌদ্ধধর্ম পতনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, যেগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল -

রাজাদের সাহায্যের অভাব ঃ পূর্ব এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল, যার অন্যতম কারণ ছিল সেই অঞ্চলের রাজাদের আর্থিক সাহায্য। মগধের রাজা বিম্বিসার, কুষান সম্রাট কনিস্ক, মৌর্য সম্রাট অশোক প্রমুখ রাজারা এই ধর্মের বিস্তারে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায় হর্ষবর্ধনের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্য কোন রাজ শক্তি এগিয়ে আসেনি। ফলে রাজাদের সাহায্যের অভাব থাকার জন্য বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

হিন্দুধর্মের প্রভাব ঃ গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা হিন্দুধর্মের বহু রীতিনীতি অনুকরণ করে তা বৌদ্ধধর্মের মধ্যে প্রবেশ করাতে থাকে। বৌদ্ধধর্মের মহাযান বিভাগে বুদ্ধের মূর্তি পূজা শুরু করা হয়। এর ফলে হিন্দুধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের মধ্যে পার্থক্য কমে যায়। এইভাবে বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে মিশে যায়, ফলে তা পতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

যোগ্য ধর্মগুরুর অভাব ঃ গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আর কোন সর্বজনগ্রাহ্য বৌদ্ধ ধর্মগুরুর আবির্ভাব ঘটেনি যিনি বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটাতে সক্ষম। বিভিন্ন বৌদ্ধ সংঘগুলি তাদের নিজেদের মতামত অনুসারে বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করতে থাকে ফলে নতুন করে আর বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটেনি। 

বৌদ্ধধর্মের মতভেদ ঃ বৌদ্ধধর্মের পতনের জন্য অন্যতম একটি কারণ ছিল বৌদ্ধদের মধ্যেকার বহু সম্প্রদায়গত বিভেদ। বুদ্ধের অনুগামীরা প্রথম পর্যায়ে থেরবাদী এবং মহাসংঘিকাতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে তারা হীনযান এবং মহাযান নামক দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তাদের ধর্মীয় আচরণ পদ্ধতি এবং রীতিনীতির মধ্যে বহু বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। এই সমস্ত বিভেদের ফলে বৌদ্ধধর্ম দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

বৌদ্ধসংঘগুলির দুর্নীতি ঃ গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং শ্রমণদের জন্য বৌদ্ধসংঘ স্থাপন করেছিলেন। বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এইসব বৌদ্ধসংঘগুলিতে দুর্নীতির প্রবেশ ঘটে এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ভোগবাদী হয়ে পড়ে। এর ফলে সংঘগুলির নৈতিক অবক্ষয় হয়, পাশাপাশি এখানে আচারসর্বস্বতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইভাবে বৌদ্ধধর্ম তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পতনের দিকে এগিয়ে যায়। 

আক্রমণ ঃ বৌদ্ধধর্মের পতনের জন্য সর্বশেষ কারণকে দায়ী করা যায় বিভিন্ন শক্তির আক্রমণের ভিত্তিতে। হিন্দু পণ্ডিত শংকরাচার্যের নেতৃত্বে অদ্বৈতবাদের প্রসার ঘটে। হিউয়েন সাং এবং বৌদ্ধগ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প  অনুসারে গৌড়রাজ শশাঙ্ক ছিলেন বৌদ্ধ বিদ্বেষী। কারণ তিনি অনেক বৌদ্ধ বিহার এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেছিলেন। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বহু বৌদ্ধকে হত্যা করেছিলেন। হুন আক্রমণ এবং তুর্কি আক্রমণ ছিল বৌদ্ধদের ওপর চরম আঘাত। হুন এবং মুসলিমরা বহু বৌদ্ধ মঠ, বিহার ইত্যাদি ধ্বংস করেছিল। ফলে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটে।

মূল্যায়ন ঃ যাই হোক এত কিছু পরেও, এত শতাব্দী পরেও ভারতবাসীর মনে বুদ্ধের ত্যাগ, ক্ষমা ও করুণার বাণী আজও অম্লান। আর ভারতের বাইরে আজও বহু দেশ গৌতম বুদ্ধের অনুগামী। 

আরও পড়ুন ঃ

➤ বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও

➤ বৌদ্ধ ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা করো

Post a Comment

Previous Post Next Post