প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বলতে কি বোঝ (What do you mean by Eastern problem) -প্রশ্নটি নিয়ে।
পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা -
ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই পূর্বাঞ্চল সমস্যা দেখা দেয়। নিকট প্রাচ্য চিরকালই ইউরোপীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। অঞ্চলটি ছিল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার মিলনক্ষেত্র এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য -এই দুই সভ্যতার সঙ্গে বহু প্রাচীনকাল থেকে জড়িত সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল।
বৈশিষ্ট্য ঃ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পূর্বাঞ্চল সমস্যার মূলত চারটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
এগুলি হল - (১) তুরস্কের পতন (২) রাশিয়ার আগ্রাসী নীতি (৩) নিকট প্রাচ্য অঞ্চলের জনগণের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা (৪) পূর্ব ইউরোপের ব্যাপারে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের নীতি।
চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতকে তুরস্ক ছিল বহু ভাষাভাষীর এক বিশাল সাম্রাজ্য। এখানে সাধারণত গ্রিক, রোমানীয়, বুলগেরীয়, আলবেনীয় প্রভৃতি ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস ছিল এবং বর্ণের দিক থেকে তারা শ্বেতকায় ছিল। ধর্মের দিক থেকে এই সব মানুষেরা ছিলেন প্রাচীনপন্থী ক্রিশ্চিয়ান। তুরস্কের সেনাবাহিনীতে তুর্কি, আরবীয়, জানিজারিস প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অংশ ছিল। ঊনবিংশ শতকে তুরস্কের পতন ঘটলে তুরস্ককে ইউরোপের অসুস্থ মানুষ বা "Sickman of Europe" নামে আখ্যায়িত করা হয়।
প্রভাব ঃ প্রশাসনিক দিক থেকে তুরস্করা একেবারেই মেধাবী ছিল না। তারা নিঃসন্দেহে রাজ্য বিজয়ী ছিল কিন্তু সুশাসক তারা কোনদিন হতে পারেনি কারণ তাদের সরকার ছিল দুর্নীতিপরায়ণ এবং অদক্ষ। সুলতান ছিলেন সংস্কার প্রবর্তনের বিরুদ্ধে। জাতীয়তাবাদ এবং উদারতাবাদের যুগে তুরস্ক সাম্রাজ্য পুরাতন ঐশ্বরিক তত্ত্বে বিশ্বাসী থাকায় তাদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তুরস্কের পতনের সুযোগে প্রাদেশিক শাসকেরা বা 'পাসা'রা বার বার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এই সময় পাশা মেহেমত আলি মিশরে স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করেছিলেন এবং বলকান অঞ্চলে আলি পাশা আলবেনীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তুরস্ক সাম্রাজ্য ভাঙনের দিকে অগ্রসর হয়।
রাশিয়ার আধিপত্য ঃ তুরস্কের সুলতানদের পতন হলে সেখানে এক রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য অগ্রসর হয়। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারীন তুরস্কের ওপরে কুচুককাইনার্জি চুক্তি আরোপ করে। এইভাবে ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেন অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপিত হয়।
একদিকে যেমন রাশিয়া তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে অন্যদিকে তেমনই তুরস্কের সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঝড় উঠছে। বলকান অঞ্চলে রাশিয়া এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ও প্রভাব বলকান অঞ্চলে প্রবেশ করে সেখানে জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণ করেছিল যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে আত্মপ্রকাশ করে। নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করে যখন আরবের পথ ধরে ভারতে আসার পরিকল্পনা করে, তখন ব্রিটেন বলকান অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বিশেষ যত্নবান ছিল। কারণ সেই সময় তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্যতম অংশ ছিল মিশর এবং আরব। বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার অনুপ্রবেশ তুরস্কের জন্য যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল। এইভাবে যখন একদিকে বলকান জাতীয়তাবাদ এবং অন্যদিকে তুরস্কের সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে রাশিয়ার অনুপ্রবেশের প্রতিরোধ - এই দুই সমস্যার মধ্যে আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলি বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এভাবেই নিকট-প্রাচ্য সমস্যার প্রকৃতি এক জটিল আকারে পরিণত হয়।
পূর্বাঞ্চল সমস্যা এবং প্যারিসের শান্তি চুক্তি ঃ পূর্বাঞ্চল সমস্যা সমাধানের জন্য - (১) রাশিয়ার সম্প্রসারণ নীতি (২) তুরস্কের দুর্বলতা - এই দুটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে প্যারিসের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সামুদ্রিক ব্যবস্থা বিনষ্ট হলে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া প্যারিসের শান্তি চুক্তি নস্যাৎ করে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক পুনরায় রাশিয়া আক্রমণ করলে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের ওপর স্যানস্টিফানোর চুক্তি চাপানো হয়। এর ফলে তুরস্কের ওপর রাশিয়ার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইজন্যই ষাটের দশকের ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এবং প্যারিসের শান্তি সম্মেলন পূর্বাঞ্চল সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক সাম্রাজ্য আরও কিছুকাল স্থায়িত্ব পেয়েছিল।
আরও পড়ুন ঃ