বর্তমান যুগে ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করো

প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "বর্তমান যুগে ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করো (Impact of globalization in India)"- এই প্রশ্নটি। 

আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম একটি প্রধান ধারণা হল বিশ্বায়ন বা Globalization. ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ শাসকরা একদিকে যেমন অর্থলগ্নি করে অন্যদিকে তারা নানাভাবে ভারতের সম্পদ লুঠ করে ভারতকে নিঃস্ব-রিক্ত করে তোলে। একপেশে মুক্ত বাণিজ্য নীতি প্রয়োগ করে ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। বর্তমান কালে সেই প্রবহমান ধারার যে প্রভাব লক্ষ করা যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন নিন্মে আলোচনা করা হল -


বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতিপূরণ ঃ বিশ্বায়নের যুগে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির আমলে ভারত উদারীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ভারতে বিশ্বায়নের দরজা জানালা খুলে দেন। তখন ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির দোসর করে নেওয়া হয়। এই ব্যাপারটীকে বলা হয় TINA অর্থাৎ There is no Alternative. ভারতে বিশ্বায়ন তার ব্যাঘ্র থাবা বসাতে থাকে এবং ভারতের বাজারে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিলগ্নিকরণ, বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের চাপ ভারত সরকারকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, IMF এবং MNC -এর মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ঋণের ফাঁদে ফেলে দেয়।


প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও-এর আমল ঃ পি. ভি. নরসিমা রাও IMF, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রস্তাবিত ভারতীয় বাজারের কাঠামোগত সংস্কার শর্তে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করেন এবং এদেশের বাজার বিশ্বায়নের কারবারিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। পুঁজির গমনাগমনের পথে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করেন। আমদানি শুল্ক হ্রাস করেন এবং বাণিজ্য গোষ্ঠীর অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। এর ফলে ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে বিশ্বায়নের সবথেকে বড় মৃগয়াক্ষেত্র। 


ভারতীয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ঃ বিশ্বের ক্রমপরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও বর্তমান বাণিজ্যের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ভারতে তৈরি না হওয়ায় পূর্ব এশিয়ায় ভারতের আর্থিক অগ্রগতি কচ্ছপ গতিতে এগিয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর 1969 সালে ব্যাংক জাতীয়করণ, অল্পসুদে কৃষি ও শিল্পের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সামনে রেখে দ্রুত শিল্পায়নের চেষ্টা, কিন্তু 1960 খ্রিস্টাব্দে ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ঘটলেও নিন্মবিত্ত মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকায় স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়নি। বিশ্বের অগ্রগতির সাথে সমান তালে প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতি না হওয়ায় সারা দেশে সবুজ বিপ্লব সফল হয়নি। 

ভারতের কৃষি অর্থনীতির ওপর প্রভাব ঃ ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বায়ন সম্পূর্ণভাবে পণ্যনির্ভর ও শিল্পমুখী হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বহুগুণ কমেছে। ফলে কোথাও কোথাও খাদ্যসংকট দেখা দিচ্ছে। 


সতর্কতার কুফল ঃ ভারতবাসীর কাছে বিশ্বায়নের ফল ভালো না হওয়ায় মুক্ত বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভারতের যে বিদেশি পুঁজি আসছে তা উৎপাদন প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে বেশি বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থনীতির কুপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আর ভারতীয় বাজার থেকে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তের সঞ্চিত অর্থ কর্পূরের মত উবে যায়।

শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে কৃষিজমি নষ্ট ঃ বিশ্বায়নের দাপটে আজ ভারতের কৃষক বিপন্ন হয়েছে। দেশি-বিদেশি শিল্পপতি ও পুঁজিপতি এবং বহুজাতিক কোম্পানির রাক্ষুসে থাবায় বহু কৃষক পরিবার তাদের একমাত্র আবাধযোগ্য জমি হারিয়েছে। যেমন - গুজরাটে উকাই বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের ফলে সত্তর হাজার উপজাতি পরিবার উদবাস্তুতে পরিণত হয়েছে।


পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট ঃ বিশ্বায়নের ফলে ভারতে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার ভয়াবহ দূষণ বাতাসে ছড়াচ্ছে, যা পরিবেশ বান্ধব নয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ভুপাল ভয়াবহ কার্বাইড কারখানার ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অবাধ বাণিজ্যনীতির সুযোগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। 

পশ্চিমী সংস্কৃতির প্রভাব ঃ বিশ্বায়নের ফলে ভারতের সংস্কৃতি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। পশ্চিমী ভোগবাদী সংস্কৃতি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। বিশ্বায়ন মূলত প্রাচ্য সংস্কৃতি, সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করতে চাইছে।


         সবশেষে বলা যায় যে, বিশ্বায়নের প্রভাব আজ সমাজের সর্বস্তরে দেখা দিচ্ছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি এবং দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় পারবে বিশ্বায়নের কুপ্রভাবমুক্ত বাচার রাস্তা খুঁজে দিতে।

Post a Comment

Previous Post Next Post