মেটারনিক ব্যবস্থা কি ? এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?

প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "মেটারনিক ব্যবস্থা কি ? এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?" - এই প্রশ্নটি নিয়ে।

মেটারনিক ব্যবস্থা -


ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পতনের জন্য যেসব দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল  তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল অস্ট্রিয়া। মেটারনিক ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী, যার সম্পূর্ণ নাম প্রিন্স ক্লিমেন্স ফন মেটারনিক। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা কংগ্রেসের মধ্যমণি হিসাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাছ যেমন ঘূর্ণি জলে বিনা বাঁধায় চলাফেরা করে, ভিয়েনা সম্মেলনের কূটনৈতিক ঘূর্ণি জলেও মেটারনিক মাছের মতই অবাধে বিচরণ করতেন। নানান জন তার সম্পর্কে নানান মন্তব্য করেছেন। যেমন রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার তাঁকে 'মিথ্যাবাদী' বলে আখ্যায়িত করেছেন, ক্যাসলবি তাকে 'রাজনৈতিক ভাঁড়' বলেছেন। তবে নেপোলিয়নের মতে মেটারনিক ছিলেন একজন 'চক্রান্তকারী রাজনৈতিক নেতা'। 


মেটারনিক ব্যবস্থা কি? 

          এককথায়, মেটারনিক ব্যবস্থা কি? সেটা বললে বোঝায় পরিবর্তনবিমুখতাকে। মেটারনিকের মতে ফরাসি বিপ্লব প্রসূত উদারনৈতিক চিন্তাধারাগুলি ছিল 'রাজনৈতিক মহামারী' বা 'বহু মস্তক বিশিষ্ট দৈত্য'। তিনি ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারাগুলিকে পরিবর্তন করতে তিনি অরাজি ছিলেন। যেমন - ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য, জাতীয় রাষ্ট্রের আদর্শ, নিয়মতান্ত্রিক শাসন এসব।  ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে মেটারনিক ইউরোপের অভিজাততন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং পুরোহিততন্ত্রকে সমর্থন করেছিলেন। ইউরোপের  শাসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন " রাজত্ব করবেন কিন্তু সংস্কার বা পরিবর্তন করবেন না"। মেটারনিক তাঁর নীতির মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।  অস্ট্রিয়ায় ছিল নানা ভাষা ও নানা জাতির লোকের বাস। তাই তিনি মনে করেন যদি ফরাসি বিপ্লবের প্রগতিশীল চিন্তাধারা অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে তাহলে অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই কারণে তিনি সব জায়গায় প্রতিক্রিয়াশীল নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এই ছিল মেটারনিক ব্যবস্থা বা মেটারনিকতন্ত্রের প্রধান আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য।


মেটারনিক ও ইউরোপ ঃ 

          ভিয়েনা কংগ্রেসের ন্যায্য অধিকার, শক্তি সাম্য নীতি এবং ক্ষতিপূরণের নীতিকে মেটারনিক সমর্থন প্রদান করেছিলেন। এরপর ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। ইতালির জাতীয়তাবাদকে নস্যাৎ করা হয় এবং সেখানে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। মেটারনিক ইতালিকে শুধুমাত্র একটি ভৌগলিক সংজ্ঞা হিসাবে উল্লেখ করতেন। "জার্মান বুন্ড" গঠন করে তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ না করার চেষ্টা করেন। এরপর জার্মানিকে ৩৮ টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং ইউরোপের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বন্ধ করার জন্য তিনি শক্তিসমবায়কে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে থাকেন। রাশিয়াকে তিনি তার দলে টানেন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ট্রপোর ঘোষণাপত্র। জার্মানিতে প্রগতিশীল চিন্তাধারা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তিনি কার্লসবাড ডিক্রি জারী করেছিলেন। এটির মাধ্যমে জার্মানির উদারপন্থী ছাত্র এবং শিক্ষকদের নিগৃহীত হতে হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের স্রোত যেন জার্মানিতে প্রবাহিত হতে না পারে তার জন্য মেটারনিক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। অস্ট্রিয়ার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে তিনি সবরকম সংস্কারমূলক কাজ বন্ধ রাখার পাশাপাশি শিক্ষক ও ছাত্রদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা শুরু করেন। স্কুল এবং কলেজগুলিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়। শিক্ষাকে চার্চের অধীনে আনা হয় এবং অস্ট্রিয়ার শিল্পের অগ্রগতিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেটারনিকের উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়াকে কৃষি প্রধান এবং সামন্ততান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা। এইভাবে মেটারনিক ইউরোপে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইত্যাদি দিক থেকে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।

          ধীরে ধীরে মেটারনিক প্রবর্তিত ব্যবস্থা তাসের ঘরের মত ভেঙে যায়। মেটারনিক ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের প্রবাহ অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করা থেকে আটকাতে পারলেও ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রবাহকে আটকাতে তিনি ব্যর্থ হন। ভিয়েনাতে ছাত্র এবং শ্রমিকদের বিদ্রোহ শুরু হলে তিনি তার পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান এবং এরফলে মেটারনিক ব্যবস্থার পতন ঘটে।


মেটারনিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং সার্থকতা ঃ 

          মেটারনিক ব্যবস্থা সার্থকতা পেয়েছিল কি ব্যর্থ হয়েছিল শে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতপার্থক্য দেখা যায়। কারও মতে মেটারনিক "মেটারনিক নীতি" নামে যে নীতি  প্রচার করেছিলেন তা ছিল প্রকৃতপক্ষে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্সিসের নীতি। সুতরাং, বলা যায় যে নীতি মেটারনিক নীতি নামে পরিচিত তা আসলে "ফ্রান্সিস জোসেফ নীতি"। মেটারনিক অস্ট্রিয়ার প্রদেশগুলিকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে চাইলে ফ্রান্সিস তার বিরোধিতা করেন। আবার কেউ কেউ এরকম বলেছেন যে, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রনে রাখা, গুপ্তচর নিয়োগ ইত্যাদি নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থাগুলি মেটারনিক কখনোই প্রবর্তন করেননি। এসবের জন্য দায়ী ছিল মেটারনিকের অন্যতম দুই প্রতিপক্ষ কাউন্ট কোলাভার্ট ও কাউন্ট সেভনিটসকি। অস্ট্রিয়ার সম্রাট এইসব দমননীতির সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাই এসবের জন্য মেটারনিককে কোন ভাবেই দায়ী করা চলে না।

           অপরপক্ষে অনেকে এটাই দাবী করেছেন যে মেটারনিক-ই এসব দমনমূলক নীতিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন পরিবর্তন বিরোধী। তিনি তাঁর নীতির মাধ্যমে স্থিতাবস্থাকেই বজায় রাখতে চেয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন পুরাতনপন্থীর সমর্থক। ফরাসিবিপ্লবের  যেসমস্ত প্রগতিশীল চিন্তাধারা ইউরোপকে আন্দোলিত করেছিল মেটারনিক তার চরম বিরোধিতা করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে যে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করা উচিত, তা তিনি বোঝেননি। তিনি যুগের ধারার বিরুদ্ধে কাজ করতে চেয়েছিলেন তাই ব্যর্থ হয়েছিলেন । তিনি ছিলেন সংস্কার বিমুখ। তাই তিনি দুঃখ করে বলেছেন, তিনি পৃথিবীতে হয় দেরিতে এসেছেন না হয় আগে চলে এসেছেন। 

          এসব কিছুর মধ্যেও বলা যায় যে, তার নীতি একেবারে ব্যর্থ হয়নি। তিনি যতদিন পেরেছিলেন ইউরোপে ভিয়েনা ব্যবস্থা জারী রেখেছিলেন। নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপে দীর্ঘকালীন শান্তি ও স্থিতি মেটারনিক দিতে পেরেছিলেন।

          অনেকে বলেছেন, তার এইসব স্থিতিশীল নীতি প্রয়োগ করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য রক্ষা করার। কিন্তু দেখা যায় এরফলে অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের ক্ষতিই হয়েছিল। কারণ তিনি স্থানীয় প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেননি ফলে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয় এবং তার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।


আরও পড়ুন ঃ



Post a Comment

Previous Post Next Post