বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও

আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রী, সকলকে আমার সাইটে স্বাগত। আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও (Introduce the religious life of the Vedic age)"- এই বিষয়টি সম্পর্কে।

আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল বেদ। বেদ থেকেই আমরা জানতে পারি আর্যদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে। চারটি বেদ সহ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত এবং ষড়দর্শন থেকে বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন কেমন ছিল তা জানা যায়। যেহেতু বৈদিক যুগকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, সেহেতু বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবনকেও দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা - একটি হল ঋগবৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন এবং অপরটি হল পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন। নিন্মে ঋগবৈদিক এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল - 


ঋগবৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন ঃ 

     বহুত্ববাদী তত্ত্ব ঃ ধর্মের ক্ষেত্রে ঋগবেদের আর্যরা বহুত্ববাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত। যেমন - দ্যৌ, পৃথিবী, ইন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি। দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্র ছিলেন, তিনি ছিলেন ধ্বংস এবং বজ্রের দেবতা। ঝড়ের দেবতা মরুৎ, আগুণের দেবতা ছিলেন অগ্নি, বাতাসের দেবতা ছিলেন বায়ু, আকাশের দেবতা ছিলেন দ্যৌ, জলের দেবতা বরুণ, ভুমির দেবতা পৃথিবী প্রভৃতি দেবতাদের প্রচলন ছিল ঋকবৈদিক যুগে। এই সময় অদিতি, উমা, সরস্বতী, সাবিত্রী নামে কিছু দেবীদেরও অস্তিত্ব ছিল।

      প্রকৃতি পূজা ঃ ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা প্রকৃতি পূজা করত। তাদের বিশ্বাস ছিল পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বর আছে। তাই এসময় তারা প্রকৃতির বিভিন্ন রুপকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। আর্যরা এই সময় সূর্য, চন্দ্র, পাহাড়, জল প্রভৃতি সবকিছুর পূজাই করত। ঋকবৈদিক যুগে মানুষ মনে করত যে, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদি ঘটনাগুলির পিছনে কোন দৈবশক্তির হাত আছে।

     যাগযজ্ঞ ঃ দেবতাদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই সময় বিভিন্ন পূজা, যজ্ঞ, প্রার্থনার আশ্রয় নেওয়া হত। ঋগবৈদিক যুগে দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশুবলি দেওয়া হত। যজ্ঞের আগুনে ঘি, মধু, মাংস, সোমরস ইত্যাদি আহুতি দেওয়ার রীতি লক্ষ্য করা গেছে। এইসব যাগযজ্ঞ এবং পূজা-অর্চনা পরিচালনার দায়িত্ব ছিল পুরোহিত শ্রেণি ওপর। যজ্ঞের সময় দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্র পাঠ করা হত।
আরও পড়ুন ঃ ⇩



পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন ঃ 

     দেবদেবীর পরিবর্তন ঃ ঋগবৈদিক যুগে প্রচলিত দেবতা যেমন - ইন্দ্র, অগ্নি, মিত্র, বরুণ প্রমুখ দেবতাদের জনপ্রিয়তা পরবর্তী বৈদিক যুগে হ্রাস পেতে থাকে এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রমুখ দেবতা পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রধান দেবতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় ব্রহ্মাকে বলা হয় সৃষ্টি কর্তা, বিষ্ণুকে বলা হয় পালনকর্তা এবং শিবকে প্রলয়কর্তা হিসাবে অভিহিত করা হত।

     ধর্মীয় জটিলতা বৃদ্ধি ঃ ঋগবৈদিক যুগে ধর্মের ক্ষেত্রে বেশি জটিলতা সৃষ্টি হয়নি কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে ধর্মের ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় যাগযজ্ঞের বাহুল্য, আড়ম্বরপ্রিয়তা ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। মূর্তিপূজার প্রচলন ব্যাপক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তী বৈদিক যুগে এসে ধর্মীয় ক্ষেত্রে পুরোহিত শ্রেণির আধিপত্য সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে পুরোহিতরা চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়। ব্রাহ্মণরা যাগযজ্ঞের দায়িত্বে ছিলেন, 'হোত্রী' নামক পুরোহিতরা মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবতাদের আহ্বান করতেন, সামগানের দায়িত্বে ছিলেন 'উদগাত্রী' শ্রেণির পুরোহিতরা এবং 'অধুর্য্য' শ্রেণির পুরোহিতরা পুঁথি দেখে মন্ত্রপাঠ করতেন। এই যুগে মানুষ ভূত, প্রেত, দানব, তন্ত্রমন্ত্র, কালাজাদু ইত্যাদির ওপর বেশি করে বিশ্বাস করতে শুরু করে ফলে সমাজে তান্ত্রিক, ওঝা ইত্যাদি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। 
     জন্মান্তরবাদের উদ্ভব ঃ এই সময় ধর্মীয় ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি, যগযজ্ঞ, পূজা-পাঠ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আড়ম্বরতা বৃদ্ধির ফলে জন্মান্তরবাদের উদ্ভব ঘটতে থাকে। আরণ্যক এবং উপনিষদ মতে ধর্মের প্রধান লক্ষ হিসাবে মোক্ষ লাভের কথা বলা হয়েছে। মানুষ এই সময় কর্মফলের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, জীবনের সুখ-দুঃখ সবই কর্মের ফল। সেজন্য এই যুগে মানুষ মানসিক শান্তি লাভের জন্য সন্ন্যাস ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।

সবশেষে বলা যায় যে, ঋগবৈদিক যুগে আর্যরা প্রকৃতি পূজা, বহুত্ববাদী ইত্যাদিতে বিশ্বাস করত কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে দেবদেবী পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের বিশ্বাসেরও পরিবর্তন ঘটে। যাগযজ্ঞ, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি বাড়তে থাকে। তাই এই সময় থেকে মুক্তির জন্য মানুষ সন্ন্যাসের দিকে পা বাড়াতে শুরু করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post