আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ গুলি আলোচনা করো

 আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ -

(১) মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি ঃ সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করাকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে ধরা হয়। মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ হলে অধিকার ক্ষুণ্ণ হবার ক্ষেত্রে নাগরিক প্রতিবিধানের জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ হলে জনগণও তাদের অধিকার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারে। অধিকার ভঙ্গের ক্ষেত্রে তারা প্রতিকার লাভের জন্য সচেষ্ট হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ইত্যাদি রাষ্ট্রে সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তিতে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে।

(২) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ঃ মন্তেস্কু, ম্যাডিসন, ব্ল্যাকস্টোন প্রমুখ লেখকগণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে উল্লেখ করেছেন। সরকারের কাজ পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ রয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা হল, একই ব্যক্তি বা একই বিভাগের হাতে বিভিন্ন ক্ষমতা ন্যস্ত হলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সাথে সাথে স্বৈরাচারের সম্ভাবনা থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু অনেকের মতে, যান্ত্রিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে কখনোই ব্যক্তি-স্বাধীনতার নিশ্চিতকরণ হয়না। 

(৩) আইনের অনুশাসন ঃ আইনের অনুশাসনকে অনেকেই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মনে করেছেন। এটা ইংল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থায় স্বীকৃত হয়েছে। আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায় (ক) আইনের প্রাধান্য এবং (খ) আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। প্রথম অর্থ অনুযায়ী সরকার বে-আইনি পদ্ধতিতে নাগরিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। দ্বিতীয় অর্থ অনুযায়ী সমাজের উচ্চ-নীচ ধনী-নির্ধন সকলেই আইনের চোখে সমান সুযোগ সুবিধা লাভ করবে। এভাবে আইন দ্বারা সংরক্ষণের ফলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে।

     কিন্তু আইনগত ক্ষমতারও অপব্যবহার হতে পারে। একথা অস্বীকার করা যায় না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের কোন মূল্য নেই। ধনী এবং দরিদ্রের স্বার্থের সংঘাতের ক্ষেত্রে আর্থিক কৌলীন্যই অবাধ প্রভাব বিস্তার করে ; ন্যায়বিচার লাভের সুযোগ থেকে দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হয়। সুতরাং, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আইন, বিচার সকল কিছুই সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থে কাজ করে। 

(৪) গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রাধান্য ঃ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অর্থ হল শাসন পরিচালন এবং আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। গণভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলিকে অনেক সময় স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। 

(৫) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা ঃ দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাকেও স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। দায়িত্বশীল সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সরকারকে সংযত রাখে। বিরোধী দলগুলি আইন সভার অভ্যন্তরে এবং বাইরে সরকারের নীতি এবং কর্মসূচির সমালোচনা করে জনমত গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। বিরোধী দলের সমালোচনা সরকারকে স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে প্রতিনিবৃত্ত করে। জনমত সরকারের বিরোধী হয়ে শক্তিশালী হলে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব হয় না। সুতরাং, জনমতের বিরোধিতার ভয়েই সরকার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পায় না।

(৬) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঃ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিক স্বাধীনতা উপভোগ করে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের অর্থ হল স্থানীয় সরকার ও স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রয়োগ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে কেন্দ্রীয় সরকারের একক ইচ্ছায় কোন কাজ সম্পাদিত হয় না। স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ থাকলে জনগণ নিজ অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠে।

(৭) সদাসতর্ক জনমত ঃ স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হল, জনগণের সাহসিকতা এবং সতর্কতা। জনগণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সচেতন না হলে, সতর্ক না হলে, আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির দ্বারা স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। বিনামূল্যে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিসের মতে, চিরন্তন সতর্কতাই মূল এবং স্বাধীনতার মূল মন্ত্র হল সাহসিকতা। যে কোন মূল্যে স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। জনগণের সাহসিকতা, চরম ত্যাগের বলিষ্ঠ মানসিকতা এবং সংগ্রামের নিষ্ঠাই স্বাধীনতার উপযুক্ত সংরক্ষণ সম্ভব হতে পারে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, জাগ্রত জনমতের পাশাপাশি সংবিধানে মৌলিক অধিকার ঘোষণা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সুসংহত বিরোধী হল প্রভৃতিও স্বাধীনতার উপযুক্ত সংরক্ষণের প্রয়োজন। 

আরও পড়ুন ঃ 

➤ রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় জেন্ডার-এর ধারণা বিশ্লেষণ করো 

Post a Comment

Previous Post Next Post