সেন্সরশিপ কাকে বলে

সেন্সরশিপ - 

জনগণের যে চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গিগুলি নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক বিচারধারাকে বিঘ্নিত করে, তা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিকে সেন্সরশিপ বলা হয়। সেন্সরশিপ এমন একটি পদ্ধতি যা সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণভাবে বলা যায়, যে ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয় তা যাতে যথাযথ ও কার্যকরী হয় সেই ক্ষমতা তাদের হাতে অর্পণ করা উচিত। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সেন্সরশিপ প্রবর্তনের বিষয়টি একজন ব্যক্তি অপেক্ষা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের ওপর অর্পণ করা উচিত।


     সেন্সরশিপ -এর ধারণাটি নতুন কিছু নয়। এটি সবসময়ই প্রচলিত ছিল। তবে এটির প্রতিফলন দেখা যায় দার্শনিকদের চিন্তায়। গ্রিক সাম্রাজ্যের পতনের পর যে রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, সেই প্রাচীন রোমান ইতিহাসে সর্বপ্রথম সেন্সরশিপ কথাটি ব্যবহার করা হয়। রোমান সাম্রাজ্যে 'সেন্সর' নিয়োগের বর্ণনা পাওয়া যায়। নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বশীল কর্তা হলেন সেন্সর। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই ক্ষমতা রোমের গির্জার ওপর পড়ে। মধ্যযুগের ইউরোপে, বিশ্বাসবিরোধী সাহিত্যকে চার্চ বা গির্জা অনুমোদন করত না। আধুনিক যুগের উদারনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় সেন্সরশিপের ত্রুটিগুলি ধরা পড়ে। জন লক্, অ্যাডাম স্মিথ, বেন্থাম, মিল প্রমুখ দার্শনিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হন।

    নানা ক্ষেত্রে সেন্সরশিপের ব্যবহার আছে। বই, সিনেমা, শিল্পকলা, সংবাদ প্রতিবেদন, সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যক্ত কোন মত, চিন্তা, ছবি ইত্যাদি যদি সরকারি মনে করেন তা সংগতিপূর্ণ নয় তাহলে সেইক্ষেত্রে সেন্সরশিপ প্রবর্তন হয়। 

     উদাহরণ ঃ যখন কোন সিনেমা তৈরি হয় তখন তা প্রদর্শনের পূর্বে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের অনুমতি নিতে হয়। এই বিষয় নিয়ে নানা সময়ে বিতর্কও দেখা যায়। 

     সেন্সরশিপ নানা রকমের হতে পারে। কোন ব্যক্তি যখন নিজের কাজে, মতপ্রকাশে স্বেচ্ছায় সেন্সরশিপ ব্যক্ত করেন, তখন তাকে Self-censorship বলা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে লেখক, শিল্পী বা স্রষ্টা স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে এমন কোন মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন না যা সামাজিক মূল্যবোধ পরিপন্থী বা দেশবিরোধী।

     দেশের সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সেন্সরশিপ প্রবর্তন করতে পারে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ এই দুই ভাবে সেন্সরশিপ প্রবর্তন হয়। 

     সেন্সরশিপ প্রবর্তন যেরকম সাম্প্রতিক বা নতুন বিষয় নয় সেইরকম সেন্সরশিপের বিরোধিতাও বহুকাল ধরে চলে আসছে। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তাঁর চিন্তার বিরুদ্ধে তৎকালীন রাষ্ট্র যে সেন্সর চালু করেন তিনি তা বিরোধিতা করেন। অবশেষে হোমলক বিষপানের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যু ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুইডেন বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ যে দেশে আইনের মাধ্যমে সেন্সরশিপ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়। 

     সেন্সরশিপের প্রকাশ নানাক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন - নৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, কর্পোরেট ইত্যাদি। 

     নৈতিক সেন্সরশিপ বলতে সেই ক্ষেত্রকে বোঝায় যেখানে কোন মত চিন্তা, শিল্পকলা নীতিবিরুদ্ধ বা নৈতিকতাবিরোধী বলে প্রতিভাত হয়। উদাহরণ ঃ পর্ণোগ্রাফি।

     সামরিক সেন্সরশিপ বলতে সেই সব ক্ষেত্রকে বোঝায় যেখানে সামরিক কৌশলাদি যাতে শত্রুপক্ষ অবহিত হতে না পারে সেইজন্য গোপন রাখা হয়। 

     ধর্মীয় সেন্সরশিপ সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় যেখানে কোন মত, চিন্তা, শিল্পকলা কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগকে আহত করে। 

     যখন সরকার মনে করে কোন তথ্যাদি, মত, চিন্তা সরকারবিরোধী মনোভাব জনমানসে প্রতিফলিত করে সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সেন্সরশিপ প্রচলন করা হয়।

     কর্পোরেট সেন্সরশিপ বলতে বোঝায় সেই ক্ষেত্রকে যেখানে সংবাদপত্রের মালিকরা এমন কোন তথ্যাদি তাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত করেন না যা তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

Post a Comment

Previous Post Next Post