রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় জেন্ডারের ধারণা বিশ্লেষণ করো

রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় জেন্ডারের ধারণা - 

'জেন্ডার' শব্দটির বাংলা পরিভাষা হল লিঙ্গ। 'লিঙ্গ' শব্দটিকে ইংরেজি 'Sex'  শব্দটির প্রতিশব্দ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাত্ত্বিক পরিভাষায়, ইংরেজিতে 'Sex'  এবং 'Gender' শব্দ দুটি কাছাকাছি হলেও তাদের কখনো সমার্থক বলে ধরা হয় না। বিখ্যাত নারীবাদী দার্শনিক শেফালি মৈত্রব -এর ভাষায়, "যখন 'Sex' বলতে আমরা একটি শারীরিক ক্যাটাগরি (স্ত্রী এবং পুরুষের শারীরিক প্রভেদ) বুঝি, তখন 'Gender' বলতে একটি সাংস্কৃতিক ক্যাটাগরি বোঝানো হয়, যা প্রকৃতিদত্ত নয়, সমাজনির্মিত।" যে অর্থে সমাজতত্ত্বে 'জেন্ডার' শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে কখনো লিঙ্গকে একটি জৈবিক শ্রেণিবিভাগ হিসাবে দেখানো সম্ভব নয়। 'জেন্ডার' হল জৈবিকতার অতিরিক্ত এক পৌরুষ বা নারীত্বের ধারণা যার কাল বা সমাজ নির্বিশেষে কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। নারীবাদী কর্মী এবং তাত্ত্বিক মারিয়া মীসেব-এর বক্তব্য অনুযায়ী "পৌরুষ বা নারীত্ব এবং পৌরুষ ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হয় এবং এই সংজ্ঞা নির্মাণ নির্ভর করে সেই বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর। এর ফলে নারী এবং পুরুষ তাদের নিজেদের শরীরের সঙ্গে গুণগতভাবে ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে।"

 পুঁজিবাদী সভ্যতায় সব নারীর নতুন সংজ্ঞা নির্মিত হয় গৃহবধূ হিসাবে এবং মাতৃত্ব হয়ে ওঠে এই 'গৃহবধূ' -লক্ষণের একটি অংশ হিসাবে। মারিয়া মীসেব-এর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, 'জেন্ডার' -এর ধারণা ইতিহাস এবং সমাজভেদে পরিবর্তনশীল। আবার 'জেন্ডার' বলতে কোন বিশিষ্ট সমাজের নারীসুলভ মনোবৃত্তি বা পরিপন্থী পুরুষসুলভ মনোবৃত্তিকেই বোঝায় না, এর আওতায় চলে আসে সামাজিক বিচরণক্ষেত্র, দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ, ব্যবহারের রকমসকম এসবকিছুই। পোশাকের ধারণা, বাচনভঙ্গি থেকে জীবনচর্চার পরিসর এসবের মধ্যে কোনোটা চিহ্নিত হয় মেয়েলি, আবার কোনোটা পুরুষালি হিসাবে। এই বহুবিন্যস্ত 'জেন্ডার' -এর ধারণা ভাষার ক্ষেত্রেও ধারণ করে। এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ফরাসি নারীবাদী দার্শনিক এবং 'The Second Sex' -এর রচয়িতা সিমোন দ্য বোভোয়ার। যেমন - 'man' - বলতে অনেক সময়েই সমগ্র মানব জাতিকে বোঝানো হয়। অন্যভাবে বলা যায় 'man' শব্দটি একাধারে একটি বিশেষ এবং নির্বিশেষ শব্দ। কিন্তু 'woman' শব্দটি সেদিক থেকে দেখলে একটি সীমাকরণের মাত্রা দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয়। অর্থাৎ, 'woman'  শব্দটি সংজ্ঞায়িত হয় বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত 'man' শব্দটির অন্য বা 'other' হিসাবে। তা কখনোই 'man' শব্দটির মতো সমগ্র মানবজাতির প্রতিশব্দ নয়। 

নারী এবং পুরুষের জৈবিক অর্থে বিভাজনের বাইরে নারীত্ব এবং পৌরুষের ধারণা নির্মাণের মধ্যে জড়িয়ে থাকে প্রতিটি সমাজের জটিল এবং দীর্ঘ চিন্তাপ্রণালী। জৈবিক বিভাজনও এক বিস্তৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নারীত্ব এবং পৌরুষের বিভাজন - এই দুই বিভাজনের পার্থক্যকে বোঝানোর জন্য নারীবাদীরা 'sex' বা লিঙ্গের পরিবর্তে 'gender' শব্দটি ব্যবহার করেন। অন্যভাবে বলতে গেলে সমগ্র মানব সভাতায় বিভিন্ন সামাজিক এবং আত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্মিত নারী এবং পৌরুষের ধারনাকে নির্দেশ করা হয় 'জেন্ডার' শব্দটির দ্বারা। অধিকার, কর্তব্য, পরিচিত, ব্যবহারিক রীতিনীতি, এসমস্ত মিলে তৈরি করে কোন সমাজের সাংস্কৃতিক আদর্শের ধারণা যার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি নিজেকে নারী এবং পুরুষ হিসাবে চিনতে শেখে। আবার সিমোন দ্য বোভোয়ার -এর বিখ্যাত উক্তি - "কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে" ("One is not born but rather becomes a woman)"। এই কথাটি যেমন নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ঠিক তেমনি পুরুষের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তবে 'জেন্ডার' -এর ধারণা যদি সমাজ কালভেদে নিছক বিচিত্রকেই  নির্দেশ করত তবে বিশেষ সমস্যা ছিল না। কিন্তু 'জেন্ডার' শব্দটি কোন অর্থেই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। কেবল নারীত্ব এবং পৌরুষের বিভাজনই নয়, 'জেন্ডার' শব্দটি নারী-পুরুষের অসম ক্ষমতা সম্পর্ক এবং নারীর সামাজিক অধীনতারও নির্দেশক। এর জন্যই শব্দটি রাজনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

বর্তমান যুগে রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা কারো পক্ষেই 'জেন্ডার' বিষয়টি অগ্রাহ্য করে নীতি প্রণয়ন ও গ্রহণ করা সম্ভব নয়। প্রথাগত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল বিষয় হিসাবে এতকাল উচ্চ রাজনীতির ক্ষেত্রই চলে এসেছে। যেমন - যুদ্ধ, চুক্তি, ক্ষমতার লড়াই বা আইনি এবং প্রশাসনিক বিষয়। এসমস্ত প্রথাগত বিষয় হল পুরুষ প্রাধান্যের ক্ষেত্র, কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই ক্ষেত্রগুলিকে এতকাল 'জেন্ডার' নৈর্ব্যক্তিক ক্ষেত্র হিসাবে দেখে এসেছে। 'জেন্ডার' বিষয়টি সেভাবে আলোচিত হয়নি, কিংবা হলেও একটি বিচ্ছিন্ন অধ্যায় হিসাবে যার সঙ্গে বাকি অধ্যায়ের বিশ্লেষণের কোন সম্পর্ক নেই। 

নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বহুদিন ধরেই এই জ্ঞানচর্চার ধারাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। মূলস্রোতের রাজনৈতিক চিন্তা বা মতাদর্শ 'রাজনীতি' বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা সরকার, রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী - অর্থাৎ, বহির্জগতের নায়কদের নিয়েই আবর্তিত। এই বিভেদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নারিবাদ বলে যে ঘনিষ্ঠ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বিষয়গুলিকে 'ব্যক্তিগত ক্ষেত্র' বলে অভিহিত করে, রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে রাখা অযৌক্তিক। নারীবাদীরা বলেন, যে বাড়িতে একজন নারী-পুরুষের সম্পর্ক এমনকি তাদের যৌন সম্পর্কও তথাকথিত বহির্জগতের রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত এবং এই সম্পর্কগুলি আবার বহির্জগতের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে।

ব্যক্তিজগতের অস্তিত্ব, তার পরিধি, তার প্রকৃতি, তার অনুমোদিত আচার-আচরণ ইত্যাদি সবকিছুইই বহির্জগতের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন - আইনসভা, বিচারালয়, আমলাতন্ত্র, প্রভৃতির দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই সিদ্ধান্তগুলি গৃহস্থালিতে অসম ক্ষমতার বিন্যাস তৈরি করে। অপরদিকে পারিবারিক সিদ্ধান্ত বহির্জগতের অসম ক্ষমতার বিন্যাস তৈরি করে। 

পারিবারিক জীবনে সন্তান লালন-পালন এবং গৃহস্থালি কাজকর্মকে মহিলাদের কাজ হিসাবে দেখা হয় এবং এই চিন্তার দ্বারা সকলের সামাজিকীকরণ ঘটে। এইভাবে পরিবারেই পুরুষ এবং নারীর ক্ষমতার তারতম্য ঘটে। এই বিশেষ সামাজিকীকরণ ও অসম ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে বড়ো হওয়া ব্যক্তিরা যখন আনুষ্ঠানিক রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিতেই এই অসম ক্ষমতার বিন্যাসের প্রতিফলন দেখা যায়। 

চরমপন্থি নারীবাদীরা গণপরিসর ও ব্যক্তিগত পরিসরের বিভাজন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, রাজনীতিকে কেবল গণপরিসরের অঙ্গ হিসাবে দেখার ফলে নারীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অদৃশ্য বর্গ হিসাবে থেকে গেছে। এছাড়া পুরুষপ্রধান সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রীয় চরিত্রের যথার্থ অনুসন্ধান করবার চেষ্টা করেননি। তা দেখতে চেষ্টা করেনি যে রাষ্ট্রীয় চরিত্রও কীভাবে মূলত পিতৃতান্ত্রিক এবং কীভাবে গার্হস্থ পরিবারে নারীদের সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে। যদিও পরবর্তীকালে অবশ্য রাষ্ট্র এবং নারী সমস্যার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন উঠেছে এবং রাষ্ট্রকে মূলগত ভাবে নারীস্বার্থের পরিপন্থী হিসাবে দেখা হয়নি। তবে বর্তমানে সকলেই যে বিষয়টি সম্পর্কে সহমত তা হল ব্যক্তিগত পরিসরকে ঠিক যেরকম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে করা হত তা ঠিক তেমন নয়। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে এই দুই পরিসরের সীমানা ক্রমাগত নির্ধারণ করতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণপরিসর রাজনীতির একমাত্র ক্ষেত্র হিসাবে দেখার ফলে সমগ্র রাজনীতির ধারণাই সংজ্ঞায়িত হয়েছে। পুরুষের নিরিখে এবং বিমূর্ত ব্যক্তি বলতে চিহ্নিত করা হয় পুরুষকেই। এর ফলে সমগ্র রাজনীতি শব্দটিরই নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার দাবি উঠে আসছে। শুধুমাত্র তথাকথিত 'রাজনিতি'তে যেসব নারীরা প্রবেশ করেছে তাদের মূল্যায়ন নয়, সমগ্র রাজনীতির ধারণাটিরই অর্থ অনুষঙ্গ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন সম্পর্কে কতকগুলি বিষয়ের প্রতি লক্ষ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন - 

(১) 'নারী' বিষয়ের ওপর ঝোঁক মানে কেবল নারীর বিষয়টি প্রথাগত তত্ত্বায়নের সঙ্গে যোগ দেওয়া নয়, প্রথাগত বিশ্লেষণের পদ্ধতি পরিবর্তন করা। 

(২) 'নারী' মানে শ্রেণি-ধর্ম-নির্বিশেষে একটি বর্গ নয়। তাই পৃথক অবস্থানে নারী সমস্যার তারতম্য, রকমফের সবই বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠা উচিত। 

(৩) 'জেন্ডার' শব্দটি নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্ক নির্দেশ করে। তাই 'জেন্ডার'-এর অন্তর্ভুক্ত এই আন্তঃসম্পর্কের নিরিখেই করতে হবে। 

পরিশেষে বলা যায় যে, নারীবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আনুষ্ঠানিক। 

আরও পড়ুন ঃ

➤ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি আলোচনা করো 

Post a Comment

Previous Post Next Post