রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য -
সাধারণ অর্থে রাষ্ট্র ও সরকার -এই দুটি শব্দকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সরকারের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রকে তত্ত্বগত ধারণা বলে মনে করা হয়। সেজন্য অনেক সময় রাষ্ট্র এবং সরকারকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু সাবেকী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেক সময় রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
হবস তাঁর 'Laviathan' গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সরকার শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন।
ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই তাঁর শাসনকালে গর্বের সহিত ঘোষণা করেছিলেন যে, "আমিই রাষ্ট্র"।
অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, দৈনন্দিন শাসনকার্যে রাষ্ট্র ও সরকার এক ও অভিন্ন।
রাষ্ট্র ও সরকার -এই শব্দ দুটিকে অনেক সময় সমার্থক অর্থে ব্যবহার করা হলেও এই দুটি ধারনার মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
সরকার রাষ্ট্রের একটি অংশমাত্র ঃ রাষ্ট্র বলতে বোঝায় জনসমষ্টিযুক্ত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমিকতা ইত্যাদি নিয়ে গঠিত একটি জনসমাজ। আর রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করে যে সংস্থা তাকে সরকার বলা হয়। রাষ্ট্রের ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্যগুলি সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবে রূপ পায়। কিন্তু তা বলে রাষ্ট্র ও সরকার কখনোই এক নয়, কারণ কোন কিছুর অংশ সেই পুরো অংশের সমান হয় না। মানব শরীরের হৃৎপিণ্ড যেমন শরীরের একটা অঙ্গ সমগ্র শরীর নয়, সেরকমই সরকার রাষ্ট্রের একটি অংশ হতে পারে কিন্তু সমগ্র রাষ্ট্র কখনোই হতে পারে না।
ভূখণ্ডগত পার্থক্য ঃ রাষ্ট্র ও ভূখণ্ড একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রাষ্ট্র বলতে কোন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে বোঝায় কিন্তু সরকার বলতে কোন ভূখণ্ডকে বোঝায় না। সরকার হল রাষ্ট্রের শাসন, আইন, বিচারকার্যে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ।
সংখ্যাগত পার্থক্য ঃ সমগ্র জনসমষ্টিকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয় কিন্তু সরকার গঠিত হয় অল্প সংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে। রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচারকার্যে যারা যুক্ত থাকে তাদেরই এককথায় সরকার বলা হয়ে থাকে। রাষ্ট্র হল সমগ্র জনসংখ্যা এবং সরকার হল রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার একটি মুষ্টিমেয় ভগ্নাংশ। সুতরাং এদিক থেকেও রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
ধারণাগত পার্থক্য ঃ রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ভাবগত ধারণা এবং সরকারের বাস্তব কার্যাবলীর মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র মূর্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বলা যায়, সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ভাবাদর্শ বাস্তবরূপ গ্রহণ করে।
স্থায়িত্বগত পার্থক্য ঃ রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্যের অন্যতম একটি বিষয় হল স্থায়িত্ব। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চিরকাল কিন্তু সরকারের স্থায়িত্ব পরিবর্তনশীল। বিভিন্নভাবে সরকার পরিবর্তন হয় যেমন - আইনগত পদ্ধতি, দেশের রাজবংশের পরিবর্তন, বিল্পব ইত্যাদি। সরকার পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্র সবসময়ই অবিচ্ছিন্ন এবং অক্ষুণ্ণ থাকে। সুতরাং বলা যায় রাষ্ট্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব।
ক্ষমতাগত পার্থক্য ঃ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম মৌলিক ক্ষমতা থাকলেও সরকারের নিজস্ব কোন মৌলিক ক্ষমতা নেই। তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। কিন্তু এই ক্ষমতা রাষ্ট্রের নিজস্ব নয়, সরকার এই ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাছ থাকে পেয়ে থাকে। কাজেই সরকার পরিবর্তন হলে এই ক্ষমতা অন্য সরকারের কাছে চলে যায়। ল্যাস্কি বলেছেন, সরকারের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে কার্যকরী করে তোলা।
প্রকৃতিগত পার্থক্য ঃ যেকোন রাষ্ট্রের প্রকৃতি তথা রূপ একই রকমের হয় এবং রাষ্ট্রের চারটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান আছে। যেমন - জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার এবং সার্বভৌম ক্ষমতা। রাষ্ট্রের পক্ষে এই উপাদানগুলি আবশ্যক কিন্তু সরকারের এমন কোন ব্যাপার নেই। সরকার বিভিন্ন রকম হতে পারে। কোথাও রাজতান্ত্রিক সরকার তো আবার কোথাও গণতান্ত্রিক সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার আবার বিভিন্ন রকম হয় যেমন - সংসদীয়, এককেন্দ্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় তথা রাষ্ট্রপতি শাসিত।
মূল্যায়ন ঃ উপরিউক্ত কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সরকারকে অভিন্ন বলে ধরা হয়। কারণ সরকারের কাজগুলি রাষ্ট্রের বলেই ধরা হয় তাই কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে তত্ত্বগত কিছু পার্থক্য থাকলেও বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে তা সম্পূর্ণ অর্থহীন।