ভারতের সংবিধান রচনায় খসড়া কমিটির গঠন ও ভূমিকা -
খসড়া কমিটি গঠন ঃ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন বসেছিল এবং এই অধিবেশনেই খসড়া কমিটি গঠন করা হেয়ছিল। খসড়া কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. বি আর আম্বেদকর এবং আরও অন্যান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন কে. এম. মুন্সী, সৈয়দ মহম্মদ শায়েদুল্লা, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী, এম. গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, ডি. পি. খৈতান, বি. এল. মিত্র প্রমুখ। খসড়া কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন বি. এন. রাও।
খসড়া কমিটির তৎপরতা ঃ গণপরিষদ কর্তৃক খসড়া কমিটিকে কতকগুলি বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসরণ করার জন্য। ১৯৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খসড়া কমিটি গণপরিষদে ভারতীয় সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করে যেখানে সর্বমোট ৩১৫ টি ধারা ও ১৩ টি তপশীল ছিল। গণপরিষদ আইনসভা হিসাবে ১৯৪৮ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে খসড়া সংবিধানের প্রতিটি ধারা পর্যালোচনা করে দেখার কাজ শুরু হয়েছিল। এই খসড়া সংবিধানের ব্যাপারে জনমত যাচাই করার জন্য খসড়াটি দেশের সমস্ত প্রথম সারির সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়। সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা এবং সংশোধনী পেশ করার জন্য জনগণকে আট মাস সময় দেওয়া হয়।
খসড়া সংবিধানের ওপর বিতর্ক ঃ ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানটির প্রতিটি ধারার ওপর আলোচনা হয়। সংবিধানের প্রথম পাঠ হিসাবে স্বীকৃত এই সময় খসড়া সংবিধানের ওপর মোট ৭৩৬৫ টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত ২৪৭৩ টি সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক এবং আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর শেষপর্যন্ত কয়েকটি ধারা সংশোধিত হয়েছিল এবং চূড়ান্তভাবে যে খসড়া সংবিধানটি রচিত হয় তাতে ছিল ৩৯৫ টি ধারা এবং ৮ টি তপশীল। সংবিধানের দ্বিতীয় পাঠ শেষ হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৬ নভেম্বর এবং তার পরের দিন ১৭ নভেম্বর সংবিধানের তৃতীয় পাঠ শুরু হয়েছিল। এই সময় ড. বি আর আম্বেদকর গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সংবিধান গ্রহণ ও কার্যকর ঃ সুদীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়েছিল। এই সময় সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ৩৯৫ টি ধারা এবং ৮ টি তপশীল ছিল। গণপরিষদে গৃহীত সংবিধানে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ স্বাক্ষর করেন। গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশনটি বসেছিল ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি এবং এই অধিবেশনেই ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদকে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রুপে নির্বাচন করা হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। এই দিনটি সমগ্র ভারতে 'সাধারণতন্ত্র দিবস' বা 'প্রজাতন্ত্র দিবস' হিসাবে পরিচিত।
সমালোচনা ঃ সংবিধান রচনায় খসড়া কমিটির ভূমিকাটি গণপরিষদে বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন -
(i) খসড়া সংবিধানটি আলোচনার সময় খসড়া কিমিটি বহুবার তার মত বদল করেছে, যখন তখন সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, এই সব প্রস্তাব সবসময়ই সংক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্ত আকারে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে গণপরিষদের সাধারণ সদস্যরা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাননি।
(ii) যেহেতু খসড়া কমিটিতে আইনজ্ঞদের সংখ্যা বেশি ছিল তাই তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক যেকোন সমস্যা আইনের দৃষ্টিতে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। ফলে আইন ব্যবসায়ীদের মুনাফার পথ প্রশস্ত হলেও বাস্তবে অনেক সমস্যা থেকে গিয়েছিল এবং আইনজ্ঞদের জটিল আইনি বক্তব্য অনেক সদস্যই বুঝতে পারেননি। ফলে সকলের মতামত সঠিকভাবে গৃহীত হয়নি।
(iii) ভারতীয় সংবিধানের জনক বলা হয় ড. বি আর আম্বেদকর। বলা হয় তিনি কারও বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেন না, তাই তাঁর বিরুদ্ধে সবথেকে বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বলা হয় তিনি নিজেকে সবার থেকে উপরে মনে করতেন এবং তাঁর এই মনোভাব গণপরিষদের অনেক সদস্যকেই ক্ষুব্ধ করেছিল।
(iv) সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে সংবিধান রচনার ক্ষমতা ছিল কংগ্রেসের প্রধান চারজন নেতার কাছে। তারা হলেন - জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেল এবং ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ।
সবশেষে বলা যায় যে, গণপরিষদ এবং খসড়া কমিটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হলেও সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে এই দুইয়ের ভূমিকা কখনোই অস্বীকার করা যায় না। কারণ তিন বছরেরও কম সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়েছিল গণপরিষদ এবং খসড়া কমিটির জন্যই।
আরও পড়ুন ঃ