অছি ব্যবস্থা সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা -
ভারতীয় জাতির জনক তথা গান্ধিজির রাষ্ট্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল অছি ব্যবস্থা বা 'Trusteeship'. তাঁর মতে সকল ব্যক্তি যদি তাদের ধন-সম্পদের মালিকানার দ্বারা এক সামাজিক মালিকানা স্থাপন করে এবং তার মধ্যে দিয়ে আড়ম্বরহীন, সুষম, সুস্থ ও সুখী জীবনযাপন করে, তবে সমাজের মঙ্গল হবে এবং তার সুষম উন্নতি ঘটবে। সমাজের সকল ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সম্পদের সামাজিক মালিকানাকেই বলা হয় অছি বা অভিভাবক। গান্ধীজীর মতে সকল মানুষ এরূপ সামাজিক অছির অধীনে থাকলে তাদের জীবনযাপন হয়ে উঠবে সুস্থ-সুখী ও সুষম।
অছি ব্যবস্থার উৎস ঃ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি "বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়" উদ্বোধনের দিন গান্ধীজী অছিবাদের ধারণাটি লাভ করেছেন গীতার বাণীপাঠের মধ্যে দিয়ে। গীতার মধ্যে দিয়েই তিনি 'অছি' কথাটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। গীতার যে শ্লোকটির মাধ্যমে তিনি অছির ধারণাটি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটি হল-
"ঈশোবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।
তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্"।
অর্থাৎ, এই জগতের সব কিছুই ঈশ্বর প্রদত্ত। ত্যাগের দ্বারাই ঈশ্বরের সেই দানকে ভোগ করতে হবে। অপরের সম্পদে লোভ না করাই শ্রেয়।
অছি ব্যবস্থার লক্ষ্য ঃ গান্ধিজি বর্ণিত 'অছি' ব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল -
সকলের জন্য সুবিচার ঃ অছি ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে সমবণ্টন ও সুষ্ঠ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে প্রত্যেকেই সামাজিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবে এবং সকলের জীবন হয়ে উঠবে সহজ ও সরল। অছির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রিত হলে প্রত্যেকে সুবিচার লাভ করবে। এর ফলে সমাজের প্রত্যেকে প্রত্যেককে সেবা প্রদান করার সুযোগ পাবে। অছি ব্যবস্থার কল্যাণমূলক কার্যধারাকে মাথায় রেখে গান্ধিজি মনে করেন, প্রতিটি মানুষকেই এই বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে তা মেনে চলতে হবে।
প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদের সুষ্ঠ বণ্টন ঃ গান্ধিজি বলেছেন সামাজিক সম্পদকে ব্যক্তিগত মালিকানায় বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গচ্ছিত না রেখে অছি গঠন করে তার অধীনে ও নিয়ন্ত্রনে রাখতে, কারন এই সম্পদ হল সামাজিক সম্পদ। সুতরাং এই সামাজিক সম্পদের সমবণ্টন করলে সামাজিক বৈষম্য দূর হবে।
মার্কসীয় সমাজতন্ত্র থেকে পৃথক ঃ গান্ধীজীর ব্যাখ্যায় মার্কসীয় চিন্তাধারার মত পুঁজি সঞ্চয়নের কথা ছিল না। পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশের চালিকাশক্তিকে মার্কসীয় চিন্তাধারায় পুঁজির সঞ্চয় বলা হয়েছে। পুঁজির সঞ্চয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, বড় বড় কলকারখানাগুলিতে উৎপাদনের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে এবং উৎপাদনের থেকে মুনাফার ওপর নিয়ন্ত্রণও কম পরিমাণে আরোপিত হবে। গান্ধীজী মনে করতেন পূঁজির সঞ্চয়নের ফলে শোষণ ও বঞ্চনা তীব্র আকার ধারণ করবে। এই জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমগ্র সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক হতে পারে না বলে ধারণা করেছেন।
আরও পড়ুন ঃ
➤ গান্ধীজীর খেদা আন্দোলন সম্পর্কে লেখ
অছি ব্যবস্থার প্রত্যয় ঃ গান্ধীজীর মতে, অছি ব্যবস্থা দুটি প্রত্যয়ের ওপর নির্ভরশীল। যথা -
(ক) অপরিগ্রহ ঃ যারা অছির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন তারা সামাজিক সম্পদকে এমনভাবে দেখবেন যে সমাজের কোন সম্পদই তাদের ব্যক্তিগত বলে মনে হবে না, একেই বলা হয় অপরিগ্রহ।
(খ) সমভাব ঃ অছি পরিচালকদের মনে সমানভাবে বণ্টনের ধারনাকেই সমভাব বলা হয়। এই ব্যবস্থা অনুসারে যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই সে সমাজ থেকে পাবেন। ফলে এখানে কোন অহংকারবোধ জাগ্রত হবে না।
মূল্যায়ন ঃ বিভিন্ন দিক থেকে গান্ধিজির অছি ব্যবস্থা সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, এই ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সম্পদের সমবণ্টন হতে পারে।