রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদ বা ভাববাদী তত্ত্ব আলোচনা করো

আদর্শবাদ বা ভাববাদী তত্ত্ব -

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে সে সব মতবাদ প্রচলিত আছে, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি মতবাদ হল আদর্শবাদ বা ভাববাদ। আদর্শবাদ বা ভাববাদ মতবাদ আবার চরম মতবাদ, দার্শনিক বা অধিবিদ্যক মতবাদ, অতীন্দ্রিয় মতবাদ ইত্যাদি নামে পরিচিত। আদর্শবাদী বা ভাববাদীদের মতে রাষ্ট্র যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে গঠিত। তাদের মতে রাষ্ট্র শ্রেষ্ঠতম ধারনার ওপর গড়ে উঠেছে, সেজন্য রাষ্ট্র হল সর্বোত্তম গুণসমূহের প্রতীক। রাষ্ট্র হল মানুষের স্বাভাবিক, অপরিহার্য এবং চূড়ান্ত সংগঠন। মানুষের ব্যক্তিত্বের চরম বিকাশসাধন হতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যেই বাস করলে। রাষ্ট্র ন্যায় ও যুক্তির ভিত্তিতে গঠিত হয় বলে রাষ্ট্র সর্বাত্মক, অভ্রান্ত এবং ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত হয়েছে। একমাত্র রাষ্ট্রই পারে মানুষের উন্নত জীবনযাপনের পথে আসা বাধাগুলিকে দুর করতে। অর্থাৎ বলা যায়, ব্যক্তি স্বাধীনতার উৎস এবং সংরক্ষক হল রাষ্ট্র। সুতরাং, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রের নির্দেশগুলিকে যথাযথ ভাবে পালন করা।


আদর্শবাদ বা ভাববাদের বিস্তার ও দার্শনিকদের মতামত ঃ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা মতবাদগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম মদবাদ হল আদর্শবাদ বা ভাববাদ। 

অ্যারিস্টটল ও প্লেটো ঃ প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও প্লেটো -উভয়ের মতে রাষ্ট্র হল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। প্লেটোর 'Republic' নামক গ্রন্থে রাষ্ট্রের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা সবদিক থেকে নিখুঁত এবং পূর্ণতাপ্রাপ্ত। অ্যারিস্টটলের লেখা গ্রন্থে রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুন্দর জীবনের প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে রাষ্ট্র হল মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান এবং মানুষ তার সমস্ত রকম নৈতিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলি রাষ্ট্রের মাধ্যমেই পূরণ করে থাকে। 


আধুনিক দার্শনিকদের মতামত ঃ আদর্শবাদ বা ভাববাদের সূত্রপাত ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের লেখায়। তবে আধুনিককালে জার্মান দার্শনিক কান্ট, হেগেল ও ফিকটের রচনার মধ্যে আদর্শবাদ বা ভাববাদ একটি বলিষ্ঠ রূপ পেয়েছে। কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, কান্টই হল আদর্শবাদের জনক। কান্টের মতে রাষ্ট্র হল একটি সর্বাত্মক এবং অভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের মানুষদের একটি পবিত্র কর্তব্য হল রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। রাষ্ট্র একটি ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান তাই রাষ্ট্রীয় আদেশ ও নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার অধিকার জনগণের নেই। সুতরাং রাষ্ট্রের নির্দেশগুলিকে জনগণের নির্বিচারে পালন করা উচিত।


     আদর্শবাদ বা ভাববাদ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে জার্মান দার্শনিক হেগেল-এর হাত ধরে। তাই অনেকেই হেগেলকে আদর্শবাদের জনক বলেছেন। হেগেল রাষ্ট্রকে পৃথিবীতে ভগবানের পদক্ষেপ বলেছেন এবং রাষ্ট্রের ওপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র হল একটি সচেতন নৈতিক আদর্শসম্পন্ন ব্যক্তি, যার আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান, অভ্রান্ত, চূড়ান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অতিমানবীয় প্রতিষ্ঠান যা সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে।


ব্রিটিশ দার্শনিকদের সঙ্গে জার্মান দার্শনিকদের পার্থক্য ঃ কিছু ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেমন গ্রিন, ব্রাডলে, বোসাংকেত প্রমুখের রচনায় আদর্শবাদ বা ভাববাদ কিছুটা ভিন্নরূপ পেয়েছে। ব্রিটিশ দার্শনিকরাও জার্মান দার্শনিকদের মতো রাষ্ট্রকে একটি সর্বশক্তিমান, শ্রেষ্ঠতম প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করেছেন কিন্তু ব্রিটিশ দার্শনিকরা কখনোই জার্মান দার্শনিকদের মতো ব্যক্তিসত্তাকে রাষ্ট্রের কাছে বলি দেননি। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রিন বলেছেন, রাষ্ট্র যদি কোন অন্যায় করে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্যই ব্যক্তির উচিত রাষ্ট্রের কাজে বাঁধার সৃষ্টি করা। গ্রিনের পাশাপাশি বোসাংকেতও রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা স্বীকার করেছেন কিন্তু তিনি একটি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সীমারেখা টেনেছেন। অর্থাৎ দেখা যায় জার্মান দার্শনিকদের তুলনায় ব্রিটিশ দার্শনিকরা অনেক বেশি উদার ছিলেন।


মূল বক্তব্য ঃ জার্মান দার্শনিক এবং ব্রিটিশ দার্শনিকদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শবাদের মূল বক্তব্যগুলিকে নিন্মে তুলে ধরা হল -

     (i) আদর্শবাদ বা ভাববাদ অনুসারে রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন।

     (ii) আদর্শবাদীদের মতে রাষ্ট্র হল ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলে ঈশ্বরের বিরোধিতা করা হবে। রাষ্ট্রের ইচ্ছা হল সমগ্র জনগণের ইচ্ছার যোগফল তাই রাষ্ট্র কখনও অন্যায় করতে পারে না। এই মত অনুসারে রাষ্ট্র যদি অন্য কোন রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে সেটাও অন্যায় নয়। 


     (iii) আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক, প্রয়োজনীয় এবং চূড়ান্ত কর্তৃত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান
 
     (iv) আদর্শবাদীদের মতে রাষ্ট্র একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে মানুষ তাঁর চরম উৎকর্ষতা লাভ করে একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে। রাষ্ট্রই নৈতিক শক্তির স্রষ্টা, তাই রাষ্ট্র কোন নৈতিক শক্তির অধীন নয়।

     (v) রাষ্ট্রই হল ব্যক্তি-স্বাধীনতার আধার। হেগেলের মতে, কোন মানুষের স্বাধীনতা তার নিজ রাষ্ট্রেই বাস্তবায়িত হতে পারে তাই রাষ্ট্রীয় পরিবেশের মধ্যেই মানুষ তার যাবতীয় স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। 


সমালোচনা ঃ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদ বা ভাববাদী তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি ত্রুটিমুক্ত নয়। তত্ত্বটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা হয়েছে। যেমন -

     (i) তত্ত্বগত দিক থেকে ভ্রান্তি ঃ তত্ত্বগত দিক থেকে এটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ। আদর্শবাদীদের মতে, রাষ্ট্র একটি চেতনাশীল ও মননশীল প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র থেকে মানুষের স্বতন্ত্র কোন জীবন নেই। রাষ্ট্র কেবলমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান যা নাগরিকদের সার্বিক উন্নয়ন করে। সুতরাং রাষ্ট্রের ওপর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আরোপ করা একেবারেই ঠিক নয়।

     (ii) ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী ঃ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদীদের ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণাটি ভ্রান্ত। রাষ্ট্রীয় আইনকে নির্দ্বিধায় মেনে চলাকে আদর্শবাদীরা স্বাধীনতা বলেছেন, এইভাবে তারা কার্যত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছেন। 


     (iii) অস্পষ্ট ও অবাস্তব ঃ আদর্শবাদীরা রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেননি, তারা তাদের কল্পনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে চেয়েছেন। আদর্শবাদীদের মতে, নাগরিকদের প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ই হল রাষ্ট্র। তাদের মতে রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছার ওপরে প্রতিষ্ঠিত বলে রাষ্ট্র কখনো ভুল করতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত। বাস্তবে আদর্শবাদীদের এই ভাবনা সম্পূর্ণ কল্পনাবিলাস এবং আবাস্তব।

     (iv) রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন নয় ঃ আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন। কিন্তু এই ধারণা ভুল। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র ও সমাজ এক নয়। রাষ্ট্র শুধু মানুষের জন্য কিন্তু সমাজ মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সকল দিকের উন্নতিকল্পে গঠিত হয়।


     (v) মার্কসীয় সমালোচনা ঃ মার্কসবাদীরা আদর্শবাদের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে রাষ্ট্র কোন শাশ্বত ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র কেবল একটি শোষণমূলক যন্ত্র। রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে এবং রাষ্ট্রের বিলুপ্তি হয় শোষণের অবসান ঘটলে।

     (vi) বিপজ্জনক মতবাদ ঃ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে আদর্শবাদকে বিপজ্জনক মতবাদ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে, কারণ এই মতবাদ যুদ্ধকে সমর্থন করে। নীটসে, বানহার্ডি প্রমুখের মতে রাষ্ট্র হল শক্তির প্রতীক। যুদ্ধের দ্বারা রাষ্ট্রের শক্তি প্রতিভাত হয়। সুতরাং, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্যই যুদ্ধ প্রয়োজন। সমালোচকরা বলেছেন, এই মত মেনে নিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে নৈরাজ্য।


মূল্যায়ন ঃ আদর্শবাদ বা ভাববাদ সম্পর্কে সমালোচনার ঝড় উঠলেও এই মতামতের গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। এই মতামত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের কথা বলে, আইন অমান্যকারীর ওপর বল প্রয়োগের কথা বলে, মানুষের সংকীর্ণ স্বার্থকে সমষ্টিগত স্বার্থের কাছে মাথা নিচু করতে বলে। এইভাবে আদর্শবাদীরা কয়েকটি বাস্তব প্রয়োজনের কথা তাদের তত্ত্বে তুলে ধরেছেন। সুতরাং এই দিক থেকে বিচার করলে আদর্শবাদ বা ভাববাদ তত্ত্বকে কখনোই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা চলে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post