কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের জীবনে কি পরিবর্তন এনেছিল

 কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে সম্রাট অশোকের জীবন পরিবর্তন   

  ২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (মতান্তরে ২৬০ খ্রিস্টাব্দ) অনুষ্ঠিত কলিঙ্গ যুদ্ধ মৌর্য সম্রাট অশোকের জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এই যুদ্ধ একদিকে যেমন সম্রাট অশোকের ব্যক্তিজীবন পরিবর্তন করেছিল অন্যদিকে তেমনই মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপরও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্তকে সুরক্ষিত করা এবং অর্থনৈতিকভাবে মগধকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে অশোক তাঁর প্রতিবেশী রাজ্য কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন।

     হত্যালীলা ঃ মৌর্য সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে বিশাল মৌর্য বাহিনী কলিঙ্গ রাজ্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ আহত হয় এবং প্রায় কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এই ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে মগধ সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে পূর্ণতা লাভ করে। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মগধের রাজনৈতিক এবং সাম্রাজ্যবাদের দিকগুলি উন্নত হয়েছিল। 

     রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঃ কলিঙ্গ যুদ্ধের এই ভয়াবহতা মৌর্য সম্রাট অশোকের মনে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করেছিল ফলে তিনি তাঁর রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি যুদ্ধনীতি বর্জন করেন। এই যুদ্ধের পর অশোক অহিংসার মাধ্যমে মানুষের অন্তর জয় করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এরফলে মগধের সীমান্তবর্তী চোল, চালুক্য, পাণ্ড্য ইত্যাদি রাজ্যগুলিকে জয় করার আর কোনরূপ পরিকল্পনা তিনি করেননি। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি শান্তিবাদী নীতি অনুসরণ করেছিলেন এবং এই সময় তাঁর বিদেশ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছিল বিদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার। 

     অশোকের ব্যক্তিজীবন পরিবর্তন ঃ কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্রাট অশোকের জীবন পাল্টে দিয়েছিল। মনে তৈরি হয়েছিল অনুশোচনা। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতায় তাঁর অন্তর কেঁপে ওঠে এবং মানসিক শান্তি লাভের জন্য তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। এই যুদ্ধ সম্রাট অশোককে 'চন্ডাশোক' থেকে 'ধর্মাশোক'-এ পরিণত করেছিল। এর ফলে তিনি রাজ্য জয়ের নীতি ত্যাগ করেন। গ্রহণ করেন ধর্মবিজয়ের নীতি। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো সাধারণ জীবনযাপন শুরু করেছিলেন এবং ধর্মের নানা দিকে ঝোঁক তৈরি হয়।

     বৌদ্ধধর্মের প্রচার ঃ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে সম্রাট অশোক দেশজুড়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন রাজকর্মচারীর পদ সৃষ্টি করেছিলেন। যেমন - মহামাত্র, ধর্মমহামাত্র, মহারক্ষিত, মধ্যন্তিক ইত্যাদি। তিনি বিভিন্ন স্থানে লিপি খোদাই করেন এবং গৌতম বুদ্ধের বাণীগুলি প্রচার করতে থাকেন। ভারতের বাইরে কাশ্মীর, নেপাল, সিংহল প্রভৃতি দেশেও তিনি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য দূত প্রেরণ করেছিলেন।

     প্রজাকল্যাণ ঃ 'চণ্ডাশোক' থেকে 'ধর্মাশোক'-এ পরিণত হওয়ার পর সম্রাট অশোক প্রজাকল্যাণের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। সমস্ত প্রজাকে তিনি তাঁর নিজের সন্তানের মত মনে করতেন। প্রজাদের সুবিধার জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে কূপ খনন, বৃক্ষরোপণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি স্থাপন করেছিলেন। সম্রাট অশোকের করা এই কাজগুলি ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতার পর অশোকের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল তারই ফল।

    সবশেষে বলা যায় যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক শান্তিকামী নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় ও বৈদেশিক নীতিতে বিভিন্ন পরিবর্তন করেছিলেন। ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যে শান্তি ও সুস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার সহ আরও অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোকের আর কোন যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল না। তাই সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও মর্যাদাবান করার লক্ষ্যে শান্তিবাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। 

Post a Comment

Previous Post Next Post