আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করো

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বাস্তববাদী তত্ত্ব -

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভাববাদকে স্থানচ্যুত করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তববাদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাস্তববাদ অনুসারে রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান কর্তা। বাস্তববাদীদের মতে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নৈরাজ্যের দ্বারা চালিত হয়। বাস্তববাদী তত্ত্বে কোন কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই, তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল স্বার্থপর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। 



     হানস মরগ্যানথাউ-এর নামটি বাস্তববাদী রাজনীতি তত্ত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মরগ্যানথাউ বলেছেন, মানুষের মনে ক্ষমতালিপ্সা খুবই সক্রিয়ভাবে কাজ করে। যার জন্য সে শক্তি প্রয়োগ করে এবং সমাজের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা আদায় করে। এই ক্ষমতালোভী মানুষদের উদ্দেশ্য থাকে অন্যের উপর আধিপত্য স্থাপন করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, মানবিক বা পরিবেশকেন্দ্রিক লক্ষ্যপূরণে সক্রিয় থাকে এবং রাষ্ট্রের নায়কদের উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রের শক্তি এবং সামর্থ্য বৃদ্ধি করা।

     মূল নীতি ঃ মরগ্যানথাউ তাঁর "Politics Among Nations" (1948) গ্রন্থে রাজনৈতিক বাস্তবতার ৬ টি নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল -


          (i) রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুসারে, সমাজের রাজনীতিও বৈষয়িক বিধির দ্বারা পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির তথ্য বাস্তব ঘটনা এবং তার ফলাফলের বিপরীতে উপস্থিত যুক্তিনিষ্ঠ অনুমানের যথার্থতা বিচারের মাধ্যমেই অর্থবহ হয়ে ওঠে। 

          (ii) রাজনৈতিক বাস্তববাদ জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে একটি স্থির এবং অস্থিতিশীল ধারণারুপে গণ্য করে না। প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এটিকে বিচার করতে হয়। অতএব বলা যায়, রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ নির্ভর করে। 

          (iii) রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত জাতীয় স্বার্থের ধারণা। জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অগ্রাধিকার দেয়। রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ এবং শক্তি এই দুটি ধারণাই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।


          (iv) রাজনৈতিক কার্যাবলীর নৈতিক গুরুত্বকে রাজনৈতিক বস্তুবাদ স্বীকার করে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের কার্যাবলীর ক্ষেত্রে সার্বজনীন নৈতিক ধারণাকে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টিকে দূরে রেখে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

          (v) মরগ্যানথাউ চেয়েছিলেন রাজনৈতিক ধারণাকে একটি স্বতন্ত্র ধারণা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। রাজনৈতিক বাস্তববাদ শুধু রাজনৈতিক চিন্তা করে না, বরং এর পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে। 

          (vi) রাজনৈতিক বাস্তবতা সার্বজনীন নৈতিকতা এবং আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী। মরগ্যানথাউ বলেছেন, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ বলে কিছু হয় না। বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।


     সীমাবদ্ধতা ঃ বাস্তববাদী তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ১৯৬০ এর দশক এই তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হতে শুরু করে। 

          (i) বাস্তববাদী তত্ত্বটির প্রথম ত্রুটি হল মাত্রাতিরিক্ত রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা। এক্ষেত্রে অ-রাষ্ট্রীয় কারকের ভূমিকা উপেক্ষিত হয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তববাদ কখনোই আগাম ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

          (ii) সমালোচকরা বলেছেন, বাস্তববাদী তত্ত্ব পছন্দের তুলনায় নীতি প্রণয়ন, পরিবর্তনের পরিবর্তে বিদ্যমান পরিস্থিতির সংরক্ষণ এবং মূল্যবোধের লক্ষ্যের তুলনায় পরিবেশের সঙ্গতিবিধানের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে।


          (iii) যেহেতু আন্তর্জাতিক পরিসর অস্থিতিশীল এবং নৈরাজ্যিক, সেহেতু সমালোচকদের মতে যুক্তিসঙ্গত নীতির বিশ্বস্ত পথ প্রদর্শক এবং মানদণ্ডরুপে জাতীয় স্বার্থের ধারণা একমাত্র কোন স্থিতিশীল অধ্যায় ও পরিস্থিতিতেই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। 

উপসংহার ঃ বাস্তববাদী তত্ত্বটি বিভিন্ন দিকে থেকে সমালোচিত হলেও এই তত্ত্বের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। উচিত-অনুচিত -এর প্রশ্নকে দূরে রেখে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবিক বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রনীতি রচনার পরামর্শ দিয়ে থাকে বাস্তববাদ।

Post a Comment

Previous Post Next Post