প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব "১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লবের বছর বলা হয় কেন" -এই প্রশ্নটি। প্রশ্নটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে যে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। তাহলে শুরু করা যাক ---
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত "ফেব্রূয়ারি বিপ্লব" -এর উৎস ছিল ফ্রান্স। কিন্তু এর আঘাতে সারা ইউরোপ কেঁপে উঠেছিল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপের অন্তত ১৫ টি দেশে বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লবের বছর -
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী বা চ্যান্সেলর প্রিন্স ক্লিমেন্স মেটারনিখ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে -"When France catches cold, Europe sneezes".অর্থাৎ যখন ফ্রান্সের ঠাণ্ডা লাগে, তখন সমগ্র ইউরোপই সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়। মন্তব্যটির সার্থকতা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলশ্রুতিই প্রমাণ করে। এই বিপ্লবের প্রজ্জলিত অগ্নি সমগ্র ইউরোপে দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপের অন্তত ১৫ টি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলে। এই প্রসঙ্গে ডেভিড টমসন বলেছেন - ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ জনতার যুগের সূচনা করে।
জার্মানিতে বিপ্লব ঃ জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ভাবধারা এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার সঞ্চার করেছিল। প্রাশিয়া সহ হ্যানোভার, স্যাক্সনি, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে উদারনৈতিক গণআন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ফ্রাঙ্কফোর্টে জার্মানির জাতীয়তাবাদীদের সমাবেশ ঘটে এবং তারা প্রাশিয়ারাজ চতুর্থ ফ্রেডারিক উয়িলিয়ামকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাটপদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়।
অস্ট্রিয়াতে বিপ্লব ঃ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব অস্ট্রিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আকার ভয়াবহতার রূপ নেয়। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা সহ হাঙ্গেরি ও অন্যান্য জায়গায় বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। ভিয়েনায় প্রিন্স মেটারনিখ-এর বাসভবন পর্যন্ত আক্রান্ত হয় এবং তিনি ভীত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে মেটারনিখতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। এরপর অস্ট্রিয়ার সম্রাট জনসাধারণের জন্য একটি উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তন করতে বাধ্য হন। মেটারনিখতন্ত্রের পতন হলে 'লন্ডন টাইমস্' পত্রিকায় লেখা হয় - "পুরাতনতন্ত্রের শেষ রশ্মি আজ নিভে গেল"।
হাঙ্গেরিতে বিপ্লব ঃ অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যভুক্ত হাঙ্গেরিতেও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের আগুন দেখা যায়। উত্তর হাঙ্গেরির মডিয়ার গোষ্ঠীর অধিবাসীরা লুই কুসুথের নেতৃত্বে সেখানকার স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং হ্যাপসবার্গ সম্রাট সাংবিধানিক শাসক মনোনীত হন। অপরদিকে দক্ষিণ হাঙ্গেরিতেও ক্রোট ও সার্ব জাতি জোসফ জেলাকিকের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
ইতালিতে বিপ্লব ঃ ইতালির পার্মা, মোডেনা, মিলান, ভেনিস, টাস্কানি, সিসিলি, নেপলস্ প্রভৃতি রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা যায়। এমনকি পোপের রাজ্যেও বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় সার্ডিনিয়ারাজ চার্লস্ অ্যালবার্ট তাঁর নিজ রাজ্যে একটি উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া ও মিলানের অধিবাসীরা অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীকে বিতাড়ন করে। ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে রোমে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যান্য রাষ্ট্রে বিপ্লব ঃ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব চলাকালীন বোহেমিয়ায় চেক ও স্লাভ জাতীয়তাবাদীরা তাদের দাবি আদায় করে নেয়। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালির পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন - বেলজিয়াম, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, ইংল্যান্ডে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। এই বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত হয়।
মূল্যায়ন ঃ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সাফল্য খুব বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। বিপ্লবের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে অস্ট্রিয়া প্রতি আক্রমণ শুরু করে। এর ফলে ইতালি, জার্মানি ও অষ্ট্রিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। এসব সত্ত্বেও দীর্ঘকালীন ফলাফলের বিচারে একথা বলা যায় ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবে যার সূচনা ঘটেছিল, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে তা পরিণতি লাভ করে। গুরুত্বের দিক থেকে বিচার করে ঐতিহাসিক ট্রাভেলিয়ান বলেছেন - ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ইতিহাসে দিক পরিবর্তন, যখন ইউরোপ মোর ঘুরতে ব্যর্থ হয়। যাইহোক সবদিক বিচার করে নিঃসন্দেহে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লবের বছর বলা যেতে পারে।
আরও পড়ুন ঃ
➤ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য লেখ
➤ ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা আলোচনা করো