সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের ভূমিকা -
যেকোন দেশের সর্বোচ্চ আইন হল সংবিধান। গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে কোন দেশের সংবিধান সেই দেশেরই জনগণের দ্বারা রচিত হওয়া উচিত। কিন্তু ভারতের মতো এই বিপুল দেশে সংবিধান রচনার জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের সরাসরি অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতের সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই প্রতিনিধি দল বা সংস্থাটিকেই আমরা গণপরিষদ বলে থাকি। নিন্মে সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের ভূমিকা তুলে ধরা হল -
গণপরিষদ গঠনের পটভূমি ঃ গণপরিষদ গঠনের জন্য সর্বপ্রথম দাবি তুলেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২৩ সালে। এই দাবির ভিত্তিতে ১৯৩৫ সালে তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের নির্বাচিত প্রিতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে এবং সংবিধান রচনা এবং কার্যকর করার দাবি জানায়। তবে গণপরিষদ বাস্তব রূপ পেয়েছিল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার প্রেরিত ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুসারে।
গণপরিষদের গঠন ঃ ক্যাবিনেট মিশনের সুপারিশ অনুসারে গণপরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদের মোট সদস্যসংখ্যা ৩৮৯ জন হবে বলে স্থির করা হয়। তার মধ্যে ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশগুলি থেকে ২৯২ জন সদস্য থাকবে। এর মধ্যে সাধারণের জন্য থাকবে ২১০ টি আসন, মুসলমানদের জন্য থাকবে ৭৮ টি আসন, শিখদের জন্য থাকবে ৪ টি আসন এবং দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ৯৩ জন ও চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলি থেকে ৪ জন সদস্য আসবে।
ক্যাবিনেট মিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে নির্বাচন হয় এবং কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ২৯২ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ২০৪ টি, মুসলিম লীগ পেয়েছিল ৭৩ টি এবং বাকি আসনগুলি পেয়েছিল অন্যান্য রাজনৈতিক দল। গণপরিষদের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন জওহরলাল নেহরু, ড. বি আর আম্বেদকর, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
গণপরিষদের কার্যাবলী ঃ বিভিন্ন অধিবেশনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় গণপরিষদ তার কার্যাবলীগুলি সম্পাদন করেছিল।
(i) প্রথম অধিবেশন ঃ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে দিল্লির কনস্টিটিউশন হলে। মুসলিম লিগের সদস্যরা এই অধিবেশনে যোগদান করেননি কারণ তারা পৃথক পাকিস্তান গঠনের দাবিতে অনড় ছিলেন। এই অধিবেশনে জওহরলাল নেহরু ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। এই অধিবেশনের স্থায়ী সভাপতি রুপে নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ।
(ii) দ্বিতীয় অধিবেশন ঃ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জানুয়ারি। এই অধিবেশনে কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যেমন - সংখ্যালঘু সম্পর্কিত কিমিটি, মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত কিমিটি ইত্যাদি।
(iii) তৃতীয় অধিবেশন ঃ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয়েছিল। পূর্বে গঠিত কমিটিগুলি তাদের রিপোর্ট এই অধিবেশনে পেশ করেছিল। এই অধিবেশনে সংবিধান সম্পর্কিত দুটি কিমিটি গঠিত হয়েছিল। একটি হল জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় সংবিধান কিমিটি এবং অপরটি হল সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সভাপতিত্বে প্রাদেশিক সংবিধান কমিটি।
(iv) চতুর্থ অধিবেশন ঃ গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই। এই অধিবেশনে ভারতের নতুন জাতীয় পতাকা তৈরির পরিকল্পনা স্থির হয়।
(v) পঞ্চম অধিবেশন ঃ গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন বসেছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন পরিষদের মর্যাদা লাভ করে। এই অধিবেশনেই ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি খসড়া কমিটি গঠিত হয়েছিল।
(vi) খসড়া কমিটি ও সর্বশেষ অধিবেশন ঃ ড. বি আর আম্বেদকরকে খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়েছিল। এই কমিটির অন্যান্য কয়েকজন সদস্য হলেন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, কে. এম মুন্সি, এন. মাধবরাও, টী টী কৃষ্ণমাচারী প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া কমিটি ভারতের সংবিধান রচনার কাজ শুরু করে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং সংশোধনীর পর ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয়। গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশনটি বসেছিল ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর হয় এবং এই তারিখটি ভারতে সাধারণতন্ত্র দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালিত হয়।
সমালোচনা ঃ গণপরিষদ বিভিন্নভাবে তাদের কার্যাবলী সম্পন্ন করলেও বিভিন্ন দিক থেকে এটি সমালোচিত হয়েছে।
(i) গণপরিষদের প্রতিনিধিরা সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হননি। সুতরাং বলা যায়, গণপরিষদ অগণতান্ত্রিক।
(ii) গণপরিষদ নামেই শুধু গণপরিষদ ছিল, বাস্তবে এটি ছিল কংগ্রেসের পরিষদ।
(iii) ভারতের সংবিধান একটি রাজনৈতিক দলিল। সংবিধানে ভারতীয় জনগণের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি।
সবশেষে বলা যায় যে, ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে গণপরিষদের সমালোচনাগুলিকে পুরোপুরি সত্য ভাবে ধরে নেওয়া যায় না। তবে একথা বলতেই হয় যে, গণপরিষদে কংগ্রেসের একছত্র থাকার ফলে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা তুলে সংবিধান রচনার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।
আরও পড়ুন ঃ