ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা -
ইয়ং ইতালি ঃ ম্যাৎসিনি ইতালির জনগণের মধ্যে নতুন জীবনী শক্তির সঞ্চার করার লক্ষ্যে ইয়ং ইতালি নামে একটি শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন যাতে ৩০ হাজার সদস্য ছিল।
শৈশবকাল থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ঃ ম্যাৎসিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জোনোয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মূলত চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করলেও দার্শনিক এবং বাগ্মি হিসাবেও তিনি সুপরিচিত। ইতালিকে মুক্ত করার কথা তিনি যৌবনকাল থেকেই ভেবেছেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনীর মনে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
১৮৪৮ -এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এবং ম্যাৎসিনি ঃ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে আবার ফেব্রুয়ারি বিপ্লব আরম্ভ হয়। এই প্রসঙ্গে সময় অস্ট্রিয়ার প্রিন্স মেটারনিক বলেছিলেন যে, ফ্রান্সের সর্দি হলে সারা ইউরোপ হাঁচতে শুরু করে। স্বাভাবিক ভাবেই ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফান্সের বিপ্লবের ঢেউ ইতালির ওপরও পড়ে। পিডমন্ট, মডেনা, পার্মা ইত্যাদি অঞ্চলে গণবিদ্রোহ শুরু হয়। পিডমন্টের রাজা অ্যালবার্ট ছিলেন কিছুটা উদারপন্থী প্রকৃতির। এই সময় দিকে দিকে গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
নোভারার যুদ্ধ ঃ অস্ট্রিয়ার সেনাপতি রাডেটস্কীর কাছে পিডমন্টের রাজা চার্লস অ্যালবার্ট কাসটেজার-এর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন এবং ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নোভারার যুদ্ধেও তিনি চরম ভাবে পরাজিত হন। এই পরিস্থিতিতে তিনি তার পুত্র ভিক্টর ইম্যানুয়েলের অনুকূলে পিডমন্টের সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী মধ্য ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করে বিপ্লবকে দমন করতে সমর্থ হয়।
মিলানের বিদ্রোহ ঃ মিলানের যুদ্ধের সময়ও ম্যাৎসিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেননি। এই বিদ্রোহেও তাঁর অংশগ্রহণ চোখে পড়ে। এই সময় মিলানের জনগণ চার্লস অ্যালবার্ট -এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলে ম্যাৎসিনি কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েন। এরপর অ্যালবার্টের পতন হয় এবং ম্যাৎসিনি পুনরায় ঘুরে দাঁড়ান। তিনি ঘোষণা করেন রাজাদের যুদ্ধের অবসান হয়েছে, এরপর প্রজাদের যুদ্ধ শুরু হবে। মূলত এই সময় থেকেই গ্যারিবল্ডি ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনিকে সাহায্য করেন।
রোমে প্রজাতন্ত্র স্থাপন ও পতন ঃ রোমে কিছুদিনের জন্য প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও পড়ে তার পতন হয়েছিল। ম্যাৎসিনি ছিলেন এই প্রজাতন্ত্রের অন্যতম শাসক। তিনি নানাবিধ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা চালাতে থাকে। রোমের এই প্রজাতন্ত্রী সরকারকে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রীরা একেবারেই ভালো চোখে দেখেননি। স্পেন রোমের প্রজাতন্ত্রকে আঘাত করলে ফ্রান্সও লুই নেপোলিয়নের দ্বারা রোম আক্রমণ করে। এর ফলে ম্যাৎসিনির প্রজাতন্ত্রের সাথে রাজতন্ত্র ও ক্যাথলিক মতবাদের বিরোধ শুরু হয়। এরপর রোমের প্রজাতন্ত্রের পতন হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই লন্ডনে ম্যাৎসিনির মৃত্যু হয়।
ম্যাৎসিনির কৃতিত্ব ঃ ম্যাৎসিনি তার লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি একথা ঠিক কিন্তু তার আদর্শ, দেশপ্রেম এবং ইতালির মুক্তি আন্দোলনের প্রচেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তার কার্যকলাপকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাদের মতে ম্যাৎসিনি ছিলেন ইতালির প্রাণপুরুষ তিনি ইতালির পূর্ণ জাগরণের এক আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। প্রজাতন্ত্রবাদী এবং মানবতার পূজারী হিসাবে ম্যাৎসিনি বিখ্যাত। ম্যাৎসিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইতালির ঐক্যসাধন ইতালির জনগণই সম্পন্ন করবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইতালির যুব সম্প্রদায়কে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার অভাব থাকায়, শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ম্যাৎসিনি তার লক্ষ্যে ব্যর্থ হলেও তিনি যে জাতীয় প্রেরনার পটভূমি রচনা করেছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
কাউন্ট কাভুরের ভূমিকা ও পদত্যাগ ঃ পিডমন্টের সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাউন্ট কাভুর এবং তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তার আমলে পিডমন্ট অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছিল এবং তিনি ইতালির সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতালির রাজ্যগুলি যখন পিডমন্টের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে তখন পার্সা, মোডেনা, টাস্ক্যানি ইত্যাদি জায়গায় গণজাগরণ শুরু হয়। কাভুর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ন এই সব রাজ্যগুলিকে পিডমন্টের সাথে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিনিময়ে স্যাভয় ও নীস রাজ্য দুটিকে নেপোলিয়নকে ছেড়ে দেন কাভুর। রাজ্য গুলি গণভোটের মাধ্যমে পিডমন্টের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ছিল। এরফলে ইতালির ঐক্য অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল এবং মধ্য ইটালি ও উত্তর ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। শুধু বাকি দক্ষিণ ইতালি ঐক্য। কিন্তু অস্ট্রিয়ার সাথে তৃতীয় নেপোলিয়নের ভিল্লাফ্রাঙ্কের সন্ধি কাভুর মানতে নারাজ ছিলেন। এই বিষয়ে কাভুর সার্ডিনিয়া-পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইম্যানুয়েলকে চুক্তি না মানার পরামর্শ দেন কিন্তু ভিক্টর ইম্যানুয়েল তা অগ্রাহ্য করলে কাভুর পদত্যাগ করেন।
গ্যারিবল্ডির আগমন ঃ ইতালির এমন একটা সংকটময় সময়ে আগমন ঘটে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের অপর একজন প্রাণপুরুষ গ্যারিবল্ডি। গ্যারিবল্ডি ছিলেন একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক। তিনি ছিলেন ইয়ং ইতালির সদস্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়েতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র সরকার গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সিসিলিতে কৃষক আন্দোলন ঃ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইতালির সিসিলিতে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হলে গ্যারিবল্ডির কাছে সিসিলি ও নেপলসের অধিবাসীরা সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। গ্যারিবল্ডি গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ ছিলেন। তার সেনাবাহিনীকে 'লাল কোর্তা' বলা হত।
গ্যারিবল্ডির সিসিলি ও নেপলস অভিযান ঃ গ্যারিবল্ডি তার এক হাজার লাল কোর্তা বাহিনীর সাথে সিসিলি ও নেপলসে অবতরণ করেন। এই অঞ্চল দুটিকে তিনি অধিকার করে নেন এবং এর ফলে দক্ষিণ ইতালিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এরপর তিনি ইতালিতে পোপের রাজ্য আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
গ্যারিবল্ডির অবদান ঃ গ্যারিবল্ডি এবং ম্যাৎসিনি নীতির দিকে থেকে অনেকটা কাছের লোক ছিলেন, কারণ উভয়েই ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। তিনি সিসিলি ও নেপলসকে ভিক্টর ইম্যানুয়েলের হাতে সমর্পণ করেন। এরফলে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে ইতালি রক্ষা পায়। এর ফলে তার উদারতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে একদিকে যেমন ম্যাৎসিনি, অন্যদিকে তেমনই গ্যারিবল্ডি ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। এখানে একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনের কথা বলা যায় না। অর্থাৎ ইতালির ঐক্য আন্দোলনে কাউকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবা যায়না, কারণ উভয়েই ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক।