স্পেনীয় ক্ষত -
নেপোলিয়ন স্পেন দখল করে তার ভ্রাতা যোসেফকে তিনি স্পেনের রাজসিংহাসনে বসিয়েছিলেন। নেপোলিয়নের এই ঘটনায় সমগ্র স্পেনবাসীর আত্মসম্মান ও জাতীয়তাবোধে আঘাত লাগে। তারা নেপোলিয়নের ফরাসি শাসন মেনে নেননি এবং তারা ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। উপদ্বীপের যুদ্ধে নেপোলিয়ন দীর্ঘ ছয় বৎসর যাবৎ লড়াই করে পরাজিত হয় এবং এই ঘটনা ইউরোপের অন্য দেশেও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকে প্রেরনা জুগিয়েছিল। পরাজয়ের এই অবস্থাকেই নেপোলিয়ন ‘স্পেনীয় ক্ষত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
স্পেনের ভাগ্যে স্পেনীয় ক্ষতের প্রভাব ঃ ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে ফ্রান্সের ও স্পেনের সম্পর্ক নানা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে থাকে। যেহেতু স্পেনে, ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশেরই একটি শাখা রাজত্ব করত সেহেতু ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যখন প্রথম বিপ্লবী শক্তিজোট গড়ে ওঠে তখন স্পেনও সেই শক্তিজোটে অংশগ্রহণ করে। তবে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্রান্স বিরোধী এই শক্তিজোট থেকে স্পেন নিজেকে সরিয়ে আনতে থাকে। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের সঙ্গে ফ্রান্সের ট্রাফালগারের নৌ-যুদ্ধ সংগঠিত হলে স্পেন ফ্রান্সের পক্ষেই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এই যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে নেপোলিয়নের নৌ-সেনাদের পরাজয় হয়। পাশাপাশি নৌ-শক্তির সাহায্যে ব্রিটেন আক্রমণের পরিকল্পনা নেপোলিয়নের চিরকালের জন্য ব্যর্থতায় পরিণত হয়। তবে এই পরাজয়ের পরও নেপোলিয়নের প্রভাব স্পেনীয় রাজপরিবারে থেকেই গিয়েছিল।
আইবেরীয় উপদ্বীপে হস্তক্ষেপ ঃ রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডারের সঙ্গে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষর করেছিল ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে। এই সন্ধির পর নেপোলিয়নের ক্ষমতা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় এবং নেপোলিয়ন ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের বাকি সমস্ত বৃহৎ শক্তিগুলিকে পর্যুদস্ত করে ফেলেন। ব্রিটেনের ঔদ্ধত্য খর্ব করা লক্ষ্যে নেপোলিয়ন ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন ঘোষণার মাধ্যমে তাঁর মহাদেশীয় ব্যবস্থা জারি করেন। মহাদেশীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং ব্রিটেন যাতে মাথা তুলতে না পারে তার জন্য তিনি ১৮০৭ এবং ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে আরও দুটি ঘোষণা জারি করেন এবং এর জন্য তিনি সদা তৎপর ও বিশেষ যত্নবান ছিলেন।
মহাদেশীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রাশিয়ার রাজ তৃতীয় ফ্রেডারিক ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে এবং রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন বিরোধী নেপোলিয়নের এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নেপোলিয়ন ওলন্দাজ বণিকদের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বললে তারা অসম্মত হয়। ফলে নেপোলিয়ন ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ড আক্রমণ করেন এবং তা দখল করে নেন।
জার্মানির উত্তর-পশ্চিম উপকূল নেপোলিয়ন তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। অন্যদিকে ব্রিটেনের মিত্র আইবেরীয় উপদ্বীপীয় রাষ্ট্র পর্তুগাল নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অসম্মতি জানায়। এর ফলে নেপোলিয়ন ক্ষুব্ধ হয় ও পর্তুগালকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন। পর্তুগালের প্রিন্স রিজেন্টকে নেপোলিয়ন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলেন ও পর্তুগালে অবস্থিত ব্রিটিশ সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করতে বলেন। প্রিন্স রিজেন্ট নেপোলিয়নের এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানালে নেপোলিয়ন পর্তুগালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর স্পেন ও ফ্রান্সের ফন্টেব্লুর সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি স্বাক্ষরের পিছনে নেপোলিয়নের উদ্দেশ্য ছিল পর্তুগালকে বণ্টন করা এবং প্রথমে পর্তুগাল দখল ও পরে স্পেনে অধিকার কায়েম করা। ফন্টেব্লুর সন্ধির কিছুকাল পরেই নেপোলিয়ন পর্তুগালে ফরাসি ঘাটি স্থাপন করেন এবং এই ঘটনায় ভীত হয়ে পর্তুগালের প্রিন্স ও তার মন্ত্রীসভা ব্রাজিলে আশ্রয় নেন। এইভাবে নেপোলিয়নের স্পেন অধিকারের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয়।
স্পেনে নেপোলিয়নের কর্তৃত্ব স্থাপন ঃ নেপোলিয়ন আশা করেছিলেন যে, স্পেনের রাজপরিবারের মধ্যে অকর্মণ্যতা ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে তিনি সহজেই স্পেন দখল করতে পারবেন এবং কোন জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন তাঁর হতে হবে না। যেহেতু স্পেনের জনগণ প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন সেহেতু তিনি আশা করেছিলেন যে ইতালির জনগণের মত স্পেনীয় জনগণও তাকে স্বাগত জানাবে। তারা নেপোলিয়নের ফরাসি শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করেছিল দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও কুসংস্কারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ ঃ ফরাসি সেনাবাহিনী ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেন আক্রমণ করে এবং পাম্পেলুন দখল করে বার্সিলোনা দুর্গ অবরোধ করে। স্পেনীয় প্রধানমন্ত্রী গড়য় ছিলেন সর্বজন দ্বারা ঘৃণিত ও নীতিজ্ঞানহীন। তাই স্পেনের জনগণ তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয় ও ফরাসি বাহিনীর গতিবিধিতে সন্দিগ্ধ হয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এর ফলে রাজা চতুর্থ চার্লস আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ও যুবরাজ ফার্ডিনান্দের অনুকূলে তিনি স্পেনের সিংহাসন ত্যাগ করেন। কিন্তু নেপোলিয়নের ভীতি প্রদর্শনে যুবরাজ ফার্ডিনান্দও সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যান। এইভাবে স্পেন সিংহাসনশূন্য হয়ে পড়ে ও ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন স্পেনের সরকার নেপোলিয়নের ভ্রাতা যোসেফ বোনাপার্ট-কে স্পেনের সিংহাসনে বসান। এই ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে এক গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয় কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ব্যাপারে নেপোলিয়নের কোন ধারণা ছিল না। ফলে স্পেনের এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন তাঁর পাঁচলক্ষ সৈন্য হারান। বলা যায় এই ঘটনাই নেপোলিয়নের পতনের জন্য পরবর্তীতে একাংশে দায়ী হয়েছিল।
স্পেনে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ ঃ জার্মানি ও ইতালির জনগণের তুলনায় স্পেনের জনগণ অধিকতর ঐক্যবদ্ধ ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল। স্পেনের জনগণের ঐক্যবদ্ধ এই আন্দোলন ছিল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণআন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, স্পেনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগলিক পরিবেশ আন্দোলনকারীদের জন্য অনুকূল ফলদায়ক হয়েছিল। এই আন্দোলনে স্পেনের জনগণ গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে নেপোলিয়নের সৈন্যদের নানা ভাবে বিব্রত করে। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফরাসি সেনাপতি দু-পঁ বেলেন নামক স্থানে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর নেপোলিয়নের ভ্রাতা যোসেফ বোনাপার্টও মাদ্রিদ পরিত্যাগ করে। বেলেনের পরাজয়ের ঘটলে নেপোলিয়ন নিজেই স্পেনীয় প্রতিরোধকে ধ্বংস করতে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রিদে এসে উপস্থিত হন এবং পুনরায় তিনি তাঁর ভ্রাতা যোসেফকে স্পেনের রাজা নির্বাচিত করেন। যোসেফকে সিংহাসনে বসিয়ে নেপোলিয়ন তাঁর ইচ্ছামতো স্পেন গঠন করতে লেগে পড়েন। তিনি সামন্তপ্রথাকে উচ্ছেদ করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য পুরাতন বিধিনিষেধগুলি বাতিল বলে ঘোষণা করেন। তিনি ধর্মীয় আদালত ও বহু সংখ্যক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেন এবং স্পেনের জন্য একটি নতুন সংবিধান চালু করেন। তবে স্পেনের জনগণ নেপোলিয়নের এই নতুন সংস্কার গ্রহণ করতে রাজি ছিল না।
ফ্রান্সের ভাগ্য বিপর্যয় ঃ ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাপতি লর্ড ওয়েলেসলি পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে আসেন এবং জুলাই মাসে তিনি ফরাসি সেনাপতি ভিক্টরকে পরাজিত করেন। কিন্তু লর্ড ওয়েলসলি মাদ্রিদ দখল না করেই পর্তুগালে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন রাশিয়া অভিযান করে স্পেন থেকে অধিকাংশ সেনা প্রত্যাহার করেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টোরিয়ার যুদ্ধে লর্ড ওয়েলিংটন ফরাসি বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে। এই পরাজয়ের ফলে প্রচুর পরিমাণে ফরাসি সমরোপকরণ ব্রিটিশদের হস্তগত হয় ও ফ্রান্স মধ্য স্পেন ত্যাগ করে। এই ঘটনার পর যোসেফের আর স্পেনীয় সিংহাসনে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিছুদিনের মধ্যেই লর্ড ওয়েলিংটন স্পেন থেকে ফরাসি সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে স্পেনকে সম্পূর্ণ ফরাসি বাহিনী মুক্ত করেন। এরপর ওয়েলিংটন বাহিনী পিরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে ফ্রান্স আক্রমণ করেন। ইতিমধ্যেই নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান ব্যর্থ হয় ও অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া এবং রাশিয়ার মিলিত বাহিনী নেপোলিয়নের পশ্চাদ্ধাবন করে ফ্রান্সের প্যারিসে এসে উপস্থিত হয়। এইভাবে নেপোলিয়ন সবদিক থেকে আক্রান্ত হন এবং অবস্থার কোনরূপ পরিবর্তন না দেখে নেপোলিয়ন স্বেচ্ছায় ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল ফরাসি সিংহাসন ত্যাগ করেন।
স্পেনীয় যুদ্ধের ফলাফল ঃ নেপোলিয়নের পতনের জন্য আইবেরীয় উপদ্বীপীয় যুদ্ধের ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্পেনের জনগণের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন ছিল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ। নেপোলিয়ন অনায়াসেই কোন রাজশক্তিকে পরাজিত করতে পারলেও কোন জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব ছিল না। স্পেনের জনগণের এই আন্দোলন ইউরোপের সর্বত্র নেপোলিয়ন বিরোধী আন্দোলনের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে স্পেনীয় যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে নেপোলিয়ন সবদিক থেকেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। বলা যায়, এটি একপ্রকার নেপোলিয়নের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। এই সমগ্র ব্যাপারটিকে নেপোলিয়ন 'স্পেনীয় ক্ষত' বলে অভিহিত করেছিলেন।
আরও পড়ুন ঃ