রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য -
যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষের লক্ষ্য হল ভারতকে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা। এই উদ্দেশ্য সফল করতে গেলে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রও প্রয়োজন। রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির মাধ্যমে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলির মাধ্যমে। ভারতের সংবিধান রচয়িতারা আয়ারল্যান্ডের সংবিধান অনুকরণে ভারতের সংবিধানের ৩৬ থেকে ৫১ নম্বর ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ মূলক নীতিগুলি উল্লেখ করেছেন। নিন্মে নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য তুলে ধরা হল -
তাৎপর্য ঃ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব বা তাৎপর্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে নির্দেশমূলক নীতির বাস্তব গুরুত্ব আছে আবার অন্যদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির বাস্তবে কোন গুরুত্ব নেই।
পক্ষে যুক্তি ঃ যেসকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা পণ্ডিতরা মনে করেন রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব আছে তাদের মতে -
(i) রাজনৈতিক গুরুত্ব ঃ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির রাজনৈতিক গুরুত্ব বর্তমান। কারণ নির্দেশমূলক নীতিগুলি রুপায়নে সরকার যদি উদাসীন থাকে তাহলে সরকারকে জনগণের কাছে জবাব দিতে হয়। নির্দেশমূলক নীতির বাস্তবায়নের ওপরই কোন দেশের সরকারের সাফল্য নির্ভর করে। তাই ভারতের স্বাধীনতার পর রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার বিভিন্ন সময়ে নির্দেশমূলক নীতিগুলির বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন।
(ii) সামাজিক গুরুত্ব ঃ নির্দেশমূলক নীতির সাহায্যে সংবিধান অনুসরণ করে সামাজিক বিপ্লব ঘটানো যায়। এককথায় নির্দেশমূলক নীতিগুলি হল সামাজিক বিপ্লবের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথ।
(iii) সাংবিধানিক গুরুত্ব ঃ নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে সংবিধানে স্থান দেওয়ায় নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্দেশমূলক নীতি বাস্তবায়নের জন্য দেশের কেন্দ্র সরকার সমস্ত রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিতে পারে। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করলে রাজ্য সরকারগুলির ওপর কেন্দ্র সরকার ৩৫ নং ধারা প্রয়োগ করতে পারে।
(iv) শিক্ষাগত গুরুত্ব ঃ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলির শিক্ষাগত গুরুত্ব রয়েছে। নির্দেশমূলক নীতির মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ফলে দেশের জনগণ তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত হয়েছে।
(v) জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র ঃ জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিই হল নির্দেশমূলক নীতি। যেকোন জনকল্যাণকামী দেশের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ নির্দেশমূলক নীতির সফল বাস্তবায়ন ছাড়া প্রকৃত জনকল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়।
(vi) নৈতিক গুরুত্ব ঃ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির নৈতিক গুরুত্ব বর্তমান। দেশের জনগণের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই হল নির্দেশমূলক নীতির প্রধান লক্ষ্য। এই নীতিগুলিকে বাস্তবায়িত না করলে সরকার ন্যায়বিচার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়। এর ফলে জনসাধারণের মনে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মায়।
(vii) আইনগত গুরুত্ব ঃ নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। তবে এর আইনগত গুরুত্ব আছে। নির্দেশমূলক নীতিগুলির সাহায্যে সুপ্রিমকোর্ট বিভিন্ন সময় আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করে থাকে। যেমন বিহার রাজ্য বনাম কামেশ্বর সিংহ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করার ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতির সাহায্য নিয়েছিল।
(viii) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক ঃ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি ছাড়া দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মতে মৌলিক অধিকারের গুরুত্বের থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্ব অনেক বেশি।
বিপক্ষে যুক্তি ঃ যে সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা পণ্ডিতরা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির গুরুত্বকে স্বীকার করেননা, তাদের মতে -
(i) নির্দেশমূলক নীতির উদ্দেশ্য সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও এখনও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়নি।
(ii) নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয় অর্থাৎ নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালতের দ্বারা রক্ষিত হয় না। তাই নির্দেশমূলক নীতির কোন বাস্তব গুরুত্ব নেই।
(iii) যেহেতু নির্দেশমূলক নীতিগুলি সংখ্যায় খুব বেশি তাই বাস্তবে এগুলিকে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
(iv) সরকারের ইচ্ছার ওপরেই নির্দেশমূলক নীতিগুলির বাস্তবায়ন নির্ভর করে অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করলে এগুলির বাস্তবায়ন করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। তবে নির্দেশমূলক নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে।
উপসংহার ঃ সবশেষে বলা যায় যে, নির্দেশমূলক নীতির কিছু বিপক্ষ যুক্তি থাকলেও এর গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। কারণ নির্দেশমূলক নীতিগুলি দেশের জনগণের মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছে, তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছে যা আগামী দিনে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাবে। তবে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এখনও এই নীতি পূরণ করতে পারেনি। বর্তমানে ভারত সরকারের বেসরকারিকরণ কর্মসূচি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হয়ে উঠেছে।