দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল / প্রভাব- 

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় সমগ্র বিশ্ব পরস্পরবিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে ছিল ইতালি, জার্মানি, জাপান ও তাদের সহযোগে বিভিন্ন দেশ নিয়ে গঠিত অক্ষশক্তি। অপরদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা ও তাদের সহযোগে বিভিন্ন দেশ নিয়ে গঠিত মিত্রশক্তি। দীর্ঘ ৬ বছর যুদ্ধ চলার পর অবশেষে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সমগ্র দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে পড়েছিল। নিন্মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব বা ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হল -


ধ্বংসলীলা ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অন্তত ৫ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে সামরিক ও অসামরিক উভয় প্রকার মানুষই ছিল। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং মানুষ উদবাস্তু হয়ে নিঃস, রিক্ত অবস্থায় রাস্তার ধারে ফুটপাতে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল। 

ইয়াল্টা সম্মেলন ঃ ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে মিত্রশক্তি জার্মানির পরাজয়ের বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়। এই পরিস্থিতিতে মিত্রশক্তির আমেরিকা, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড নিজেদের মধ্যে ইয়াল্টা চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। যার উদ্দেশ্য ছিল -

     (i) যুদ্ধশেষে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করবে।

     (ii) জার্মানি থেকে সম্পূর্ণরুপে নাৎসিবাদের প্রভাব মিটিয়ে দেওয়া।

     (iii) যুদ্ধশেষে জার্মানির অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

     (iv) জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নেওয়া হবে।

বিচার ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছিল যে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্যে তারা পরাজিত অক্ষশক্তির ২১ জন নাৎসি আধিকারিককে বিশ্বের শান্তিভঙ্গ, মানবতা লঙ্ঘন ইত্যাদি অপরাধে চিহ্নিত করে এবং তাদের মধ্যে থেকে ১৪ জনের ফাঁসি হয় ও বাকি ৭ জনের আমৃত্যুকাল পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়।

অর্থনীতির পুনঃজাগরণ ঃ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে 'জাতিপুঞ্জ ত্রান ও পুনর্বাসন' বা 'আনরা' প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার উদ্দেশ্যে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশগুলির ভেঙে পড়া অর্থনীতির পুনঃজাগরণ ঘটানো। এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির উদবাস্তুদের পুনর্বাসন, কৃষি ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি সম্ভব হয়।

ট্রুম্যান নীতি ঃ ব্রিটেন যখন গ্রিস, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা করে তখন আমেরিকা এই ভেবে আশঙ্কা করে যে, ব্রিটেন এইসব দেশ থেকে সেনা সরিয়ে নিলে সেখানে কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদী রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার ঘটবে। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রূম্যান তাঁর 'ট্রুম্যান নীতি' ঘোষণা করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল গ্রিস ও তুরস্কে ৪০ কোটি ডলারের সাহায্য প্রদান যাতে এইসব দেশগুলি আমেরিকার অধীনে থাকে।

মার্শাল প্লান বা মার্শাল পরিকল্পনা ঃ ট্রুম্যান নীতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জর্জ সি মার্শাল ইউরোপীয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা বা ERP (European Recovery Programme) নামে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এটিকে 'মার্শাল পরিকল্পনা' বলা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপের আর্থিক পুনরুজ্জীবন খাতে ১২০০ কোটি ডলার অর্থ মঞ্জুর করা হয়।

জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপীয় দেশগুলির অধীনে থাকা উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোচিন বা ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা এবং আফ্রিকার মিশর, সুদান ইত্যাদি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। অবশেষে এই উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। 

আমেরিকার আধিপত্য বিস্তার ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব দেশ অংশগ্রহণ করেছিল তার মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতি হয়েছিল আমেরিকার। ফলে যুদ্ধশেষে আমেরিকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরে এবং বিশ্বরাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করে।

মূল্যায়ন ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নেতৃত্বে তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গড়ে ওঠে 'উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা' বা 'ন্যাটো' (NATO) নামক একটি শক্তিজোট। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন এই ন্যাটোর বিরুদ্ধে সাম্যবাদী রাশিয়া তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে 'ওয়ারশ' চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে একটি পরস্পরবিরোধী একটি সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হতে থাকে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধের পরিবেশ বজায় ছিল। এই ঘটনা দীর্ঘ ৩০ বছর চলেছিল, যা ইতিহাসে 'ঠাণ্ডা লড়াই' নামে পরিচিত। 

Post a Comment

Previous Post Next Post