আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি -
সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে নারীদের বক্তব্যের মূল অভিমুখ হল লিঙ্গ-বৈষম্য সংক্রান্ত বিষয়। নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ও তত্ত্বসমূহকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। যেমন -
(i) সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ বিশ্ব অর্থনীতির সমস্ত কিছুর মধ্যেই যে পুরুষতান্ত্রিক বিদ্যমান অবস্থা লক্ষ্য করা যায়, নারীবাদ তার ভিত্তিমূলে আঘাত করে।
(ii) আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদ বিদ্যমান লিঙ্গ সম্পর্কের সমালোচনা করে। নারীবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির পুনর্নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নারীর অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সংবেদনশীল ও যত্নবান।
(iii) বাস্তববাদী তত্ত্বের সমর্থক মর্গেনথাউ তাঁর বাস্তববাদী তত্ত্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে পুরুষের দৈহিক শক্তির সমার্থক হিসাবে কল্পনা করেছেন। তাই প্রখ্যাত নারীবাদী প্রবক্তা অ্যান টিকনার -এর মতে, মর্গেনথাউ -এর এই তত্ত্ব লিঙ্গ-পক্ষপাতযুক্ত অযৌক্তিক ও অবাস্তবমুখী।
(iv) যুদ্ধ ও শান্তি হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারীবাদীদের মতে যুদ্ধ এবং হিংসা নারীর সুকোমল মনোবৃত্তির বিপরীতধর্মী। তাই নারীবাদীরা যুদ্ধ বা সামরিক শক্তির সাহায্যে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। তাদের মতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সহযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমাজে শান্তি স্থাপন।
(v) সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনায় নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে নারীরা কোন রাষ্ট্র নেতার দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করছে। নারীরা মহাকাশ গবেষণা, মহাকাশ অভিযান, পররাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিচালন ভার, আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
(vi) আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীরা সর্বদা মানবকল্যাণ, সামগ্রিক উন্নয়ন ও প্রগতিশীল সভ্যতার কথা বলেছেন। সুতরাং বলা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিরোধিতা করাই নারীদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।
সমালোচনা ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই - একথা ঠিক। কিন্তু নারীবাদের অবস্থান ও বিকাশ সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক দেখা যায়। এবিষয়ে সমালোচকরা বলেন -
(i) আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নারীবাদী চিন্তার একতার চেয়ে বিতর্কই বেশি সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য নারীবাদী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার পথে এগোতে পারে না।
(ii) সমালোচকদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ন্যায়, সহযোগিতা ও মৈত্রীবন্ধন কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
(iii) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নারীদের শিক্ষা, নারীর শ্রমের স্বীকৃতি, রাজনৈতিক অধিকার বাস্তবরূপ নিয়ে কতটা সুদূর প্রসারী প্রভাববিস্তার করতে পারে সেবিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মূল্যায়ন ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন দিকে থেকে সমালোচিত হলেও এর প্রাসঙ্গিকতাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে সুবিধাভোগী লিঙ্গ রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বের করে আনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন বিকল্পের সন্ধানে নিরন্তর গবেষণা নারীবাদের সাফল্যকে সুদূরপ্রসারী করেছে।