ফরাসি অঁসিয়া রেজিম বা পুরাতনতন্ত্র -
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মধ্যযুগীয় যাজকতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়গুলি দৃঢ়ভাবে চেপে বসেছিল। মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের এই ব্যবস্থাই 'অঁসিয়া রেজিম' (Old Regime) বা 'পুরাতন তন্ত্র' বলে। ফরাসি অঁসিয়া রেজিম বা পুরাতনতন্ত্রের কয়েকটি দিক হল -
স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্রের শাসন ঃ বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশ তীব্র স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র মতে রাজারা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। রাজারা তাদের কাজের জন্য একমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। তারা তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না। ফ্রান্সের অঁসিয়া রেজিম বা পুরাতন তন্ত্রের আমলের কয়েকজন অন্যতম শাসক ছিলেন ত্রয়োদশ লুই, চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই প্রমুখ।
সামাজিক শ্রেণিবিভাগ ঃ বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজে সামাজিক শ্রেণিবিভাগ এবং সামাজিক বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এই সময় সমাজ মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা - (i) যাজক শ্রেণি বা প্রথম সম্প্রদায় (ii) অভিজাত শ্রেণি বা দ্বিতীয় সম্প্রদায় এবং (iii) মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া, দরিদ্র, সাঁকুলোৎ প্রমুখদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় সম্প্রদায়। সমাজের প্রথম দুই শ্রেণি অর্থাৎ যাজক এবং অভিজাতরা ছিল বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি। তৃতীয় শ্রেণি ছিল সুবিধা-বঞ্চিত এবং উপরের দুই শ্রেণি দ্বারা শোষিত, নিপীড়িত।
যাজক ও অভিজাতদের আধিপত্য ঃ ফ্রান্সের অধিকাংশ জমির মালিক ছিল যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়। তারা বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েও সরকারকে ভূমিকর-সহ অন্যান্য করগুলি দিত না। ফলে ফ্রান্সের সকল করের বোঝা গিয়ে পড়ত তৃতীয় শ্রেণির ওপর। যাজকরা তৃতীয় শ্রেণির কাছ থেকে 'টাইদ' বা ধর্মকর আদায় করত এবং অভিজাতরা 'করভি' বা শ্রমকর-সহ অন্যান্য সামন্তকর আদায় করত। ফলে ফরাসি সমাজে যাজক ও অভিজাত শ্রেণির আধিপত্য বজায় ছিল।
মূল্যায়ন ঃ সবশেষে বলা যায় যে, অঁসিয়া রেজিম বা পুরাতনতন্ত্র মধ্যযুগীয় গোটা ইউরোপের পাশাপাশি ফ্রান্সেও দীর্ঘদিন টীকে ছিল। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন-এর মতে ফরাসি রাজার স্বৈরাচার ও পুরাতন তন্ত্রের ভিত্তি ছিল যাজক ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকার। তাদের এই ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করলে সমগ্র পুরাতনতন্ত্র ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ত। তবে শেষ পর্যন্ত ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে বিপ্লব সংগঠিত হলে 'অঁসিয়া রেজিম' বা 'পুরাতনতন্ত্র' ভেঙে পড়ে।