জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা বিচার করো

 জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের  প্রাসঙ্গিকতা -

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বের দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটের বাইরে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশিকতা, আনবিক অস্ত্রের প্রসার, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদির বিরোধিতা করা। তৃতীয় বিশ্ব জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার সহ সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে স্বীকৃতি জানায়। 

     তৎকালীন সময়ে বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে চলতে থাকা ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও দ্বি-মেরুকরণ রাজনীতির পাল্টা প্রতিক্রিয়ারুপে যে নির্জোট আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। সেজন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে। নিন্মে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হল।

জোট নিরপেক্ষ আন্দলনের প্রাসঙ্গিকতার স্বপক্ষে যুক্তি ঃ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতার স্বপক্ষে যারা যুক্তি দিয়েছেন তাদের মতে -

     (i) বর্তমান বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে জোট নিরপেক্ষ বা নির্জোট আন্দোলন বৃহৎ শক্তির ইতিবাচক কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই বলা যায় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দিক থেকে এই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

     (ii) বিশ্বায়নের প্রভাব ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে সমগ্র বিশ্ব আজ আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলির মধ্যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুপার কম্পিউটার, উদারনীতির আরোপিত শর্তে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলির ফলে সৃষ্ট এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন দক্ষিণ গোলার্ধের অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দেশগুলিকে নিয়ে 'দক্ষিণ-দক্ষিণ' সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে অসমতা দুর করতে শক্তিশালী ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।

     (iii) মানবাধিকার রক্ষায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অগ্রণী ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রীতিটি দেশের দারিদ্র দূরীকরণ থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে। 

     (iv) নয়া ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সবসময় সংগ্রাম চালিয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বৃহৎ শক্তিগুলির বিভিন্ন অর্থনৈতিক কৌশলের অন্তর্ভুক্ত না থাকে স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণ করার কথা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ঘোষণা করেছে।

     (v) জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার যে মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছিল তা একেবারে অস্পষ্ট হয়ে যায়নি। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সবসময়ই পারমাণবিক মারণাস্ত্র সহ উগ্র যুদ্ধবাদের বিরোধিতা করে এসেছে। এই বিরোধিতাই আগামী দিনে বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত করবে।

জোট নিরপেক্ষ আন্দলনের প্রাসঙ্গিকতার বিপক্ষে যুক্তি ঃ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল -

     (i) আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের সাথে সাথে বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিমেরুকরণেরও অবসান ঘটেছে। তাই বলা যায়, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের পর নতুন বিশ্বব্যবস্থায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন কার্যত ইতিহাসের রূপ নিয়েছে।

     (ii) জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যেকার বিরোধের নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতিগত বিরোধ ও বর্ণ বৈষম্যের মত সমস্যাগুলির কোন সমাধান করতে পারেনি। এইজন্য ধীরে ধীরে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। 

     (iii) প্রযুক্তির দিক থেকে বর্তমান যুগ এতটাই এগিয়েছে যে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দেশগুলি এই অগ্রগতির সাথে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায় জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি উন্নত দেশগুলির বিরুদ্ধাচারনের শক্তি হারিয়েছে। তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বর্তমান কোন গুরুত্ব নেই।

     (iv) জোট নিরপেক্ষ আন্দলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলির উদ্দেশ্য ছিল তারা তাদের নীতির মধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তে আলোচনা ও সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হবে। কিন্তু বাস্তবে তারা বহুক্ষেত্রেই প্রচলিত বলপ্রয়োগের নীতিই গ্রহণ করেছে। ফলে আন্দলনের তাৎপর্য কমে গেছে।

     (v) পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটলে নির্জোট আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া জওহরলাল নেহরু, নাসের, সুকর্ণ, ইন্দিরা গান্ধীর মত নেতৃবৃন্দের হাত ধরে গড়ে ওঠা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত নেতা বা নেত্রী পরবর্তী সময়ে আর দেখায যায়নি। তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভাটা পড়েছে।

মূল্যায়ন ঃ সবশেষে বলা যায় যে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে সমালোচনা হলেও এর প্রাসঙ্গিকতাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তৎকালীন পরিস্থিতিতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে কিছুটা শান্তির পরিবেশ বজায় ছিল। তবে একথা বলাই যায় যে, সদা পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে দৃঢ় করার জন্য নৈতিক আত্মশক্তিসম্পন্ন ও সুযোগ্য নেতার প্রয়োজন। 

Post a Comment

Previous Post Next Post