প্রতিরোধের অধিকার -
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সুদূর অতীতকাল থেকেই বিরোধিতার অধিকার বা প্রতিরোধের অধিকার একটি বিতর্কমূলক বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে। প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক প্লেটো সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের ওপর প্রাধান্য আরোপ করেছেন এবং বলেছেন সংঘবদ্ধ জীবনেই ব্যক্তির সার্থকতা। এর বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষের কোন অধিকার থাকতে পারে না। তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল বাস্তব দৃষ্টিবোধের প্রভাবে বিপ্লব ও বিদ্রোহের কারণ ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগের অবসান এবং গণতন্ত্র ও অধিকার সম্পর্কিত ধারণার সম্প্রসারণের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকারের প্রশ্নটিও বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
সাতের শতকে চুক্তি মতবাদ ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এই 'চুক্তি মতবাদ'-এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন ইংল্যান্ডের টমাস হবস। তিনি তাঁর বিখ্যাত "Leviathan" গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সমাজের উদ্ভবের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন। হবস চরম রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু আত্মরক্ষা বা জীবনের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকার স্বীকার করেছেন। জন লক্ ছিলেন ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ইংল্যান্ডের 'গৌরবময় বিপ্লব'-এর সমর্থক। তিনি ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বটি স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারবে।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্রের বিরোধিতার অধিকার অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই; সমাজের উৎপাদন কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র ধনীদের স্বার্থই সংরক্ষণ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকগণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধিতার অধিকার অপরিহার্য।
এই আলোচনা প্রসঙ্গে ভারতীয় চিন্তা নায়ক মহাত্মা গান্ধীর মতও উল্লেখ করা যেতে পারে। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, রাষ্ট্র হল ব্যক্তির উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্র মাত্র। রাষ্ট্র যন্ত্র বিকৃত হলে কিংবা জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করবার পবিত্র অধিকার রাষ্ট্রের জনগণের রয়েছে। সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই আন্দোলন বা সংগ্রাম সম্পূর্ণ অহিংসার পথে পরিচালিত হবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বারংবার প্রমাণিত হয়েছে যে, শোষকশ্রেণি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বেচ্ছায় স্বীকার করেন না, সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণকে সেই অধিকার অর্জন করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।