গুপ্ত যুগের সমাজজীবন -
ভারতের ইতিহাসের ‘সুবর্ণ যুগ’ হিসাবে পরিচিত গুপ্তযুগের সমাজ জীবন সম্পর্কে জানার জন্য গুপ্তযুগে রচিত বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র, চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিভিন্ন বিবরণ, বরাহমিহিরের বৃহৎ-সংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গুপ্ত যুগে সমাজে যেমন চতুর্বর্ণ প্রথা, দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল তেমনই সেই সময় বিভিন্ন মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাসও ছিল। গুপ্ত যুগের সমাজ জীবন কেমন ছিল সেসম্পর্কে আলোচনা করা হল –
চতুর্বর্ণ প্রথা ঃ গুপ্ত যুগে সমাজে চারটি বর্ণের মানুষের বসবাস ছিল। এই চারটি বর্ণ হল – (i) ব্রাহ্মণ (ii) ক্ষত্রিয় (iii) বৈশ্য (iv) শূদ্র প্রভৃতি। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কাজ ছিল পূজাপাঠ করা ও শাস্ত্র আলোচনা করা। ব্রাহ্মণরাই সমাজে সবচেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করত। সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্যান্য তিনটি বর্ণের মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। গুপ্ত যুগে ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিল যুদ্ধ ও রাজ্য পরিচালনা করা। ব্যবসাবাণিজ্যের কাজে মূলত বৈশ্যরা যুক্ত ছিল এবং তারা চাষবাসের সাথেও যুক্ত ছিল। সমাজের সর্বশেষ স্তরে শূদ্র সম্প্রদায়ের বাস। শূদ্ররা সমাজের উপরের তিনটি শ্রেণিকে সেবা করার কাজে যুক্ত ছিল।
গুপ্ত যুগের এই চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসবাস করত। চারটি শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে নীচে শূদ্রদের অবস্থান ছিল। বাকি তিনটি শ্রেণির আর্থিক এবং অন্যান্য দিক থেকে উন্নতি হলেও শূদ্র সম্প্রদায়ের কোন উন্নতি হত না, তাই ধীরে ধীরে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এইভাবে এক সময় এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর নেমে আসে সমাজের উপরের তিনটি শ্রেণির মানুষদের সীমাহীন অত্যাচার, শোষণ, লাঞ্ছনা প্রভৃতি।
বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা ঃ গুপ্ত যুগে ভারতে আগত চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণ অনুযায়ী, গুপ্ত সমাজে বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা প্রবল আকার ধারণ করেছিল। গুপ্ত যুগে শূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেদের অস্পৃশ্য বলে মনে করা হত। সাধারণত গ্রাম বা শহরের বাইরে তাদের বসবাস করতে হত।
চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকেও গুপ্ত সমাজের চারটি জাতির কথা জানা যায়। হিউয়েন সাঙের মতে চারটি জাতি তাদের নিজস্ব বৃত্তি পালন করতেন। এই সময় বৈবাহিক সম্পর্ক নিজ নিজ জাতির মধ্যেই স্থাপিত হত। গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণরা রাজাদের কাছ থেকে প্রচুর নিষ্কর জমি পেতেন। ফলে সমাজে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাদের কোন অপরাধমূলক কাজে শাস্তি দেওয়া হত না।
জাতিগত কঠোরতা হ্রাস ঃ গুপ্ত যুগে রচিত বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র ও গ্রন্থ থেকে একথা জানা যায় যে, এই সময় মানুষের জাতিগত পেশা বা কাজের বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ হয়নি। কারণ গুপ্ত যুগে অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা নিন্মবর্ণের মানুষের পেশা গ্রহণ করেছে। কোথাও দেখা গেছে নিন্ম বর্ণের মানুষেরা অর্থাৎ শূদ্র সম্প্রদায় উচ্চবর্ণের কাজ করছে। গুপ্তযুগের বিখ্যাত পণ্ডিত দন্ডিন তাঁর দশকুমারচরিত গ্রন্থে ব্রাহ্মণ দস্যুদের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সময় সমাজে বৈশ্য ও শূদ্র রাজাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহের প্রচলন ছিল। যা থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, এই সময় সমাজে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় এক বর্ণের মানুষের সঙ্গে অন্য বর্ণের মানুষের জাতিগত ভেদাভেদ ক্রমশ দুর হতে থাকে।
মিশ্র জাতির উদ্ভব ঃ এই সময় চারটি বর্ণ ছাড়াও বিভিন্ন উপবর্ণ ও মিশ্রজাতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে এদেশে বিদেশ থেকে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে। এইসব মানুষেরা ধীরে ধীরে ক্ষত্রিয় সমাজের অংশ হয়েছে এবং একইভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরাও ব্রাহ্মণ সমাজের অংশ হয়েছে, তবে মিশ্র জাতিগুলিকে অস্পৃশ্য বলে ধরা হত। এই সময় শবর, কিরাত ইত্যাদি উপজাতি গোষ্ঠীগুলিকে সাধারণ সমাজ থেকে দূরে অর্থাৎ চণ্ডালদের মতো গ্রামের বাইরে থাকতে হত। ধীরে ধীরে সমাজের আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং প্রয়োজনের তাগিদে শূদ্ররা কৃষিকাজের মাধ্যমে কৃষিজীবীতে পরিণত হতে থাকে, ফলে বৈশ্য ও শূদ্রদের মধ্যে সামাজিক ব্যবধান কমতে থাকে।
দাসপ্রথা ঃ গুপ্ত যুগের বিভিন্ন গ্রন্থ ও রচনা থেকে গুপ্ত যুগে প্রচলিত দাসপ্রথা সম্পর্কে জানা যায়। ব্রাহ্মণ বাদে সমাজের বাকি তিনটি সম্প্রদায়ের লোকেদের যেমন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রদের দাস হিসাবে রাখা হত। এই সময় দাসেদের কেনাবেচার জন্য বাজার বসত। গুপ্ত যুগে যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখা হত এবং তাদের ইচ্ছামত খাটানো হত। শূদ্রকের রচিত মৃচ্ছকটিকম গ্রন্থ থেকে দাসপ্রথা সম্পর্কে জানা যায়।
পরিবার প্রথা ঃ গুপ্ত যুগের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার প্রথার গুরুত্ব ছিল। মূলত একান্নবর্তী পরিবারের কথা জানা যায়। বয়স্ক ব্যক্তিকে পরিবারের কর্তা বলা হত। পরিবারের বিভিন্ন নীতি পরিবারের কর্তার দ্বারাই নির্ধারিত হত। পরিবারে পুরুষদের তুলনায় নারীদের গুরুত্ব কম ছিল। পিতার সম্পত্তির ওপর পুরুষদের অধিকার থাকেলও নারীদের কোন অধিকার ছিল না অর্থাৎ পিতার সমগ্র সম্পত্তির অধিকার ছিল পুত্রের। গুপ্ত যুগে বাল্য বিবাহের রীতি ছিল এবং নিজবর্ণের মধ্যেই বিবাহরীতি সম্পন্ন হত।
নারীর স্থান ঃ গুপ্ত সমাজে নারীদের সবসময় পুরুষদের অধীনে থাকতে হত। তবে উচ্চবর্ণের নারীদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষালাভ, নৃত্যগীত, কাব্যচর্চার মত বিষয়গুলির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই সময় রচিত কাত্যায়নস্মৃতি থেকে জানা যায়, গুপ্তযুগে নারীরা সম্পত্তির অধিকার ভোগ করতে পারত। তাছাড়া রাজ্যের শাসন কাজেও নারীদের অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে মন্ত্রোচ্চারণ ও বেদ পাঠের অধিকার নারীদের ছিল না। গুপ্ত যুগে সাধারণ নারীদের স্থান শূদ্রদেরও নীচে ছিল এবং বিধবা নারীদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। বিধবা নারীদের সবসময় কঠোর নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলতে হত। গুপ্ত সমাজে সতীদাহ প্রথা, দেবদাসী প্রথা, বহুবিবাহের মত সামাজিক ব্যাধি প্রবল আকার ধারণ করেছিল।
অবসর বিনোদন ঃ কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের প্রভুত উন্নতি গুপ্ত যুগে লক্ষ্য করা যায়। ফলে এই সময় মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। অর্থবান শ্রেণির মানুষেরা বর্তমান যুগের মত স্বচ্ছল ও স্বাধীন জীবনযাপন করত। অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে এইযুগের মানুষ সাহিত্যচর্চা, নাটক, চারুশিল্প, নৃত্যগীত ইত্যাদিকে বেছে নিয়েছিল। এই সময় মানুষ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে রঙিন পোশাক পরিধান করত। এছাড়াও মানুষ কুস্তি, দৌড়, জীবজন্তুর লড়াই-সহ আরও অন্যান্য কার্যাবলীর মাধ্যমে তাদের অবসর সময় পার করত।
শিক্ষার বিস্তার ঃ গুপ্ত যুগে শিক্ষার যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল তা ভারতীয় ইতিহাসে আর কোন যুগে ঘটতে দেখা যায়নি। গুপ্ত যুগে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ সাধারণত সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করত। নিন্মবর্ণের মানুষদের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম ছিল প্রাকৃত ভাষা। গুপ্ত রাজাদের আমলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যার মধ্যে নালন্দা ছিল শ্রেষ্ঠ শিক্ষা নিকেতন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক হাজার ছাত্র পড়াশোনা করত। নালন্দা ছাড়াও মথুরা, উজ্জয়িনি, কাঞ্চি, কাশি প্রভৃতি অঞ্চলে শিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন গ্রন্থ গুপ্ত যুগে রচনা করা হয়েছিল।
মূল্যায়ন ঃ গুপ্ত যুগের সমাজজীবন তৎকালীন সময়ের একটি আধুনিক সংস্করণের পরিচয় বহন করে। এই সময় একদিকে যেমন চতুর্বর্ণের মধ্যে দিয়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজন হচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহের মাধ্যমে এই বর্ণগুলির মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটছে। অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে কিছু মানুষ শিক্ষার প্রতি তাদের ঝোঁক বাড়িয়ে তুলছে। তবে গুপ্ত যুগে নারীদের অবস্থান, তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার অবনমন ঘটেছিল। তবে একথা স্বীকার করতেই হয় যে, গুপ্ত যুগ ভারতীয় ইতিহাসের গৌরবকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
আরও পড়ুন ঃ