প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করব প্রাচীন ভারতের গুপ্ত যুগের ইতিহাস থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন "গুপ্ত যুগ-কে কি সুবর্ণ যুগ বলা যায়"।
গুপ্ত যুগ কে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের 'সুবর্ণ যুগ' বলার কারণ -
গুপ্তযুগ ছিল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। সাম্রাজ্যের বিস্তার, উন্নত প্রশাসন, আর্থিক উন্নতি, শিল্পের অগ্রগতি, সাহিত্য ও ভাস্কর্যের অগ্রগতি, বিজ্ঞানের উন্নতি প্রভৃতি নানা দিক বিচার করে অনেক ঐতিহাসিক গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের 'সুবর্ণ যুগ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিক বার্নেট গুপ্তযুগকে প্রাচীন গ্রিসের 'পেরিক্লিসের যুগ' -এর সমতুল্য বলেছেন। নিন্মে গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সুবর্ণ যুগ বলার কারণ আলোচনা করা হল -
রাজনৈতিক ঐক্য ঃ গুপ্ত সম্রাটদের প্রচেষ্টায় বিচ্ছিন্ন ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়েছিল। সম্রাট স্কন্দগুপ্তের সময়কাল পর্যন্ত ভারতে কোন বড়ো বৈদেশিক আক্রমণ হয়নি।
উন্নত শাসনব্যবস্থা ঃ গুপ্তযুগে ভারতে উন্নত শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। গুপ্ত রাজারা ধর্মীয় বিষয়ে সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ এবং আইনের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনকল্যাণকামী গুপ্ত রাজারা জনগণের ব্যাক্তি স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের রচনায়, গুপ্তযুগের শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিচয় ধরা পড়েছে। এযুগের স্বর্ণমুদ্রাগুলি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে।
সাহিত্যের বিকাশ ঃ গুপ্তযুগে সাহিত্যের প্রভূত বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। এযুগের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্য রচনায় গুপ্তযুগকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। ঐতিহাসিক ত্রিপাঠি ভারতের ইতিহাসের গুপ্তযুগকে ইংল্যান্ডের 'এলিজাবেথের যুগ'-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই সময় সংস্কৃত ভাষা এবং সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। একদিকে এযুগের মহাকবি কালিদাসের লেখা মেঘদূতম্, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্, রঘুবংশম্, কুমারসম্ভবম্ প্রভৃতি কাব্য ও নাটক এবং অন্যদিকে ভারবির লেখা কিরাতার্জুনীয়ম্, শূদ্রকের লেখা মৃচ্ছকটিকম্, বিশাখদত্তের লেখা মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি সাহিত্য গুপ্তযুগকে বিশেষ সমৃদ্ধ করেছিল। এছাড়াও এ যুগে বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। যেমন- যাজ্ঞবল্কস্মৃতি, কাত্যায়নস্মৃতি প্রভৃতি। গুপ্ত যুগে ব্যাকরণ বিষয়ক গ্রন্থ লিখেছেন পাণিনি, পতঞ্জলি, চন্দ্রগোমিন প্রমুখ।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের উন্নতি ঃ গুপ্ত যুগে স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের প্রভূত উন্নতি লক্ষ্য করা যায় । স্থাপত্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অজন্তা, ইলোরা ও উদয়গিরির গুহামন্দিরগুলি। সাঁচি স্তুপ, দেওগড়ের দশাবতার মন্দির ইত্যাদির মাধ্যমে নতুন মন্দির নির্মাণ রীতির বিকাশ ঘটে এবং হিন্দু দেবদেবী ও বৌদ্ধমূর্তি নির্মাণ ছিল ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অমরাবতী, মথুরা, সারনাথ প্রভৃতি অঞ্চলের বুদ্ধমূর্তিগুলি গুপ্তযুগের উন্নত ভাস্কর্যের সাক্ষ্য দেয়। চিত্রকলার ক্ষেত্রে অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র সমভাবে জনপ্রিয়। মধ্যপ্রদেশের বাঘ গুহাচিত্রগুলি গুপ্তযুগের বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করে।
বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্রের অগ্রগতি ঃ গুপ্তযুগে সাহিত্য, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রেরও উন্নতি ঘটেছিল। গুপ্তযুগে গণিতে শূন্যের ব্যবহার প্রচলিত হয়। গুপ্তযুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্যভট্ট সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ-এর কারণ আবিষ্কার করেন। তিনি সূর্যসিদ্ধান্ত, দশগীতিকাসূত্র নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। এযুগে জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন বরাহমিহির, তিনি বৃহৎ-সংহিতা ও পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থ রচনা করেছেন। চিকিৎসাবিদ্যায় ধন্বন্তরি ও বাগভট্ট বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঃ গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটেছিল। ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি দেবতার পরিবর্তে এই সময় শিব, বিষ্ণু, সূর্য, দুর্গা, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবদেবীর উপাসনা শুরু হয়। গুপ্ত যুগে মূর্তিপূজা ও তন্ত্রধর্মের প্রচলন ঘটেছিল।
অর্থনৈতিক উন্নতি ঃ গুপ্তযুগে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতির ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। গুপ্তযুগে রাজকোষ সর্বদাই অর্থে পরিপূর্ণ থাকত। এই সময় ধাতুশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চর্মশিল্প ও লৌহশিল্পের বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। জলপথে ও স্থলপথে বাণিজ্য এযুগের অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়তা করেছিল।
আরও পড়ুন ঃ
গুপ্তযুগকে 'সুবর্ণ যুগ' না বলার পক্ষে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের যুক্তি -
ডি এন ঝা, ডি ডি কোশাম্বি প্রমূখ ঐতিহাসিকেরা গুপ্তযুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলে স্বীকার করেননি। কারণ তাদের যুক্তি অনুসারে -
(i) গুপ্তযুগের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির প্রভাব কেবলমাত্র সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের নিন্ম স্তরের মানুষদের মধ্যে এর কোন প্রভাব পড়েনি।
(ii) সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষদের অবস্থা ভালো থাকলেও সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না কারণ লোকে টাকার অভাবে কড়ি ব্যবহার করত।
(iii) গুপ্তযুগে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। এই সময় জাতিভেদপ্রথা, সতীদাহপ্রথা, অস্পৃশ্যতার মত সামাজিক কুপ্রথা গুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
(iv) গুপ্তযুগে ভূমিদাস প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল। ফলে সাধারণ কৃষকদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে।
উপরিউক্ত কারণ গুলির ভিত্তিতে ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা বলেছেন, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ধর্মের দিকে থেকে বিচার করে গুপ্তযুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলা গেলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গুপ্ত যুগ কখনোই 'সুবর্ণ যুগ' ছিল না।
আরও পড়ুন ঃ