ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের কারণ -
ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতে শিল্প-বাণিজ্য যথেষ্ট উন্নত ছিল। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পর ব্রিটিশদের বিভিন্ন নীতি ও আইনের ফলে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। নিন্মে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার কারণ আলোচনা করা হল -
সরকারি পদক্ষেপ ঃ ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন আইন করে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস করার চেষ্টা করে। যেমন -
(i) ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে রঙিন সুতিবস্ত্র আমদানি করা নিষিদ্ধ হয়।
(ii) ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ভারতের রেশম বস্ত্র নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়।
(iii) ইংল্যান্ডে আমদানি করা ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর ব্রিটিশ সরকার বিপুল পরিমাণ শুল্ক চাপিয়ে দেয়।
শিল্প বিপ্লব ঃ অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটলে ভারতের বাজারে ব্রিটিশ পণ্যের ছড়াছড়ি হয়ে যায়। ব্রিটিশ পণ্য দামে সস্তা এবং আকর্ষণীয় হওয়ায় ভারতীয়রা নিজেদের দেশের পণ্য বাদ দিয়ে ব্রিটিশ পণ্যের ব্যবহার শুরু করে। ফলে দেশীয় পণ্যের বিক্রি কমে যায়।
কাঁচামাল রপ্তানি ঃ ব্রিটিশ সরকার ভারতের শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ভারত পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রমশ রপ্তানিকারী দেশ থেকে আমদানিকারী দেশে পরিণত হয় এবং শিল্পের কাঁচামাল রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হয়।
বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি ঃ ব্রিটিশ সরকার ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি গ্রহণ করে। এরফলে ভারতে আমদানিকৃত ব্রিটিশ সুতিবস্ত্রের ওপর মাত্র ২ % শুল্ক আরোপ করা হয় কিন্তু ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর ১০ % শুল্ক চাপানো হয়। এইভাবে ভারতীয় বস্ত্রের দাম বেড়ে যায় এবং বিক্রি ও চাহিদা উভয়ই কমে যায়।
দাদন প্রথা ঃ চাষের ক্ষেত্রে বাংলার তাতিরা ইংরেজদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ দাদন হিসাবে নিতে বাধ্য হত। ফলে চাষির লোকসান হত এবং ইংরেজদের কাছেই বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য হত।
বণিকদের বিতাড়ন ঃ ব্রিটিশ সরকার বাংলার বস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বাংলা থেকে বহিরাগত অন্যান্য ভারতীয় পাইকারি ক্রেতাদের বিতাড়িত করে।
মূল্যায়ন ঃ ব্রিটিশরা বিভিন্ন ভাবে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস করে দিলে এদেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দেশে দারিদ্র, বেকারত্ব ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। শিল্পের কারিগররা কাজ হারিয়ে ফেলে এবং তারা কৃষিকাজে যুক্ত হতে থাকে। এরফলে ভারতীয় কৃষিতে চাপ বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের ফলাফল -
ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি, আইন, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, দাদন প্রথা ইত্যাদির ফলে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এরফলে ভারতের অর্থনীতি, জনজীবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নিন্মে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার ফলাফল আলোচনা করা হল -
আমদানিকারী দেশে পরিণত হওয়া ঃ ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারত শিল্প পণ্য রপ্তানিকারী দেশ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার ফলে ভারত ক্রমশ রপ্তানিকারী দেশ থেকে আমদানিকারী দেশে পরিণত হয়।
শিল্পজাত কাঁচামাল রপ্তানি ঃ শিল্প পণ্য রপ্তানির বদলে ভারত ক্রমশ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হয়। বণিকরা সস্তায় ভারতের কাঁচা তুলো, কাঁচা রেশম, নীল চা প্রভৃতি কিনে বিদেশে পাঠাতে শুরু করে।
বেকারত্ব বৃদ্ধি ঃ শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হলে প্রচুর ভারতীয় কারিগর ও শিল্পী বেকার হয়ে পড়ে। এরফলে এই সমস্ত মানুষ ক্রমশ কৃষির দিকে ঝুঁকতে থাকে। ফলে জমিতে চাপ বৃদ্ধি পায়। এইভাবে দিন দিন ভারতে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
নগর জীবনের অবক্ষয় ঃ ভারতের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হলে শিল্প-সমৃদ্ধ অঞ্চল যেমন ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, তাঞ্জোর, সুরাট, মসুলিপট্টম ইত্যাদির শহরগুলির জনসংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। এইভাবে নগর জীবনের অবক্ষয় হতে থাকে।
দারিদ্র বৃদ্ধি ঃ বিদেশি পণ্য কিনতে গিয়ে স্বদেশের অর্থ বিদেশে চলে যেতে থাকে। ফলে ভারত দিন দিন হত দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মূল্যায়ন ঃ ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে ভারতের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হয়ে পড়ে। দেশে অবশিল্পায়নের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। ভারতের অবস্থা একটি দরিদ্র দেশের তালিকায় চলে আসতে থাকে এবং ভারত একটি আমদানিকারি দেশে পরিণত হয়।