প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সঙ্গ শেয়ার করব "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর" / "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি কি" / "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল কি" - এই প্রশ্নটি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করো -
বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ইউরোপের বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যা শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দরজায় কড়া নাড়ে, ভঙ্গ হয় ইউরোপের শান্তি বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন - সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উগ্র জাতীয়তাবাদ, জার্মানির আগ্রাসী নীতি, সেরাজেভোর হত্যাকাণ্ড-সহ আরও বেশ কিছু। নিন্মে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করা হল -
উগ্র জাতীয়তাবাদ ঃ বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। এই সময় থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মতবাদের উদ্ভব ঘটতে দেখা যায়। যেখানে প্রতিটি দেশের মানুষ তাদের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে থাকে। ইউরোপ ছাড়াও এশিয়ার জাপান, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাব পড়েছিল।
বলকান জাতীয়তাবাদ ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চল এশিয়ার অটোমান তুর্কি শাসকদের অধীনে ছিল। এই সময় হার্জেগোভিনা ও বসনিয়া অঞ্চল দুটি সার্বিয়ার সাথে যুক্ত হতে চাইলে বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে তাদের জোরজবরদস্তি করে অস্ট্রিয়ার সাথে যুক্ত করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হার্জেগোভিনা ও বসনিয়া প্রদেশের জনগণ অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করে। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে উস্কে দিয়েছিল।
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি ঃ উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন জাতি নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে আন্দোলনে সামিল হতে থাকে। এরফলে বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা। উদাহরণস্বরূপ - আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম ঃ ইউরোপের ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব প্রথমে ঘটায় এই দুই দেশ এশিয়া ও আফ্রিকায় দ্রুত উপনিবেশ স্থাপন করতে এগিয়ে আসে। যখন জার্মানি-সহ আরও কয়েকটি দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটে তখন তারাও উপনিবেশ বিস্তারে আগ্রহী হলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘাত বাঁধে।
জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ক্ষোভ ঃ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধে প্রাশিয়ার কাছে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটলে কয়লা ও লোহা সমৃদ্ধ অঞ্চল আলসাস ও লোরেইন জার্মানির কাছে ফ্রান্স ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধে পরাজয় ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি এলাকা হাতছাড়া হলে ফ্রান্স জঙ্গি মনোভাব নিয়ে জার্মান বিরোধী শক্তিজোট গড়ে তুলতে থাকে।
পরস্পর বিরোধী শক্তিজোট ঃ বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপে পরস্পর বিরোধী দুটি শক্তি জোট গড়ে উঠতে থাকে। একদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা ত্রিশক্তি মৈত্রী বা ত্রিশক্তি আঁতাত এবং অন্যদিকে ছিল ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হওয়া ইতালি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা ত্রিশক্তি চুক্তি।
মরক্কো পরিস্থিতি ঃ ফ্রান্স মরক্কোতে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করলে জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ফ্রান্সের বিপক্ষে মরক্কোর পাশে দাঁড়ান। ফলে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
সেরাজেভোর হত্যাকাণ্ড ঃ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্ক ডিউক ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রী সোফিয়া বসনিয়া সফরে আসেন। সেখানে ২৮ জুন তারিখে সেরাজেভো শহরে এক বসনীয় ছাত্রের হাতে তারা প্রকাশ্য রাজপথে নিহত হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে চরমপত্র পাঠালে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়।
জার্মান নৌশক্তির বৃদ্ধি ঃ উপনিবেশ দখলের উদ্দেশ্যে জার্মানি নৌশক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দিলে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আতঙ্কিত হয়। ফলে ইংল্যান্ডও তাদের নৌশক্তির বৃদ্ধিতে তৎপরতা দেখাতে শুরু করে। উভয়পক্ষের নৌশক্তি বৃদ্ধি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ একটি কারণ।
জার্মানির আগ্রাসী নীতি ঃ একদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়াকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসনে উৎসাহ দেয় এবং অপরদিকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রুগারকে সমর্থন জানায়। এইসব কারণে ইংল্যান্ড ও রাশিয়া জার্মানির ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
মূল্যায়ন ঃ চরমপত্র পাঠানোর বিষয়টীকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অবশেষে অস্ট্রিয়া, সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করলে বিভিন্ন দেশ এই দুই পক্ষের দিকে যোগ দিতে থাকে। এইভাবে 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ' শুরু হয়।
আরও পড়ুন -
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল -
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গভীর ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। নিন্মে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হল -
ক্ষয়ক্ষতি ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ সৈনিকের মৃত্যু হয়। অসামরিক লোকের হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির দৈনিক ব্যয় ছিল ২৪ কোটি ডলার এবং যুদ্ধে মোট ব্যয় হয়েছিল ২৭ হাজার কোটি ডলার। জনবল এবং অর্থবলের অভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে দুর্দশা দেখা গিয়েছিল।
জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে একজাতি, এক ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে।
গণতন্ত্রের প্রসার ঃ যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে গণতন্ত্রের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ডেভিড টমসন-এর মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্রই জয়ী হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপে মাত্র পাঁচটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল কিন্তু ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ টি।
একনায়কতন্ত্রের প্রসার ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গণতন্ত্রের প্রসারের পাশাপাশি রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, তুরস্ক, স্পেন প্রভৃতি দেশে একনায়কতন্ত্রেরও প্রসার ঘটে। যুদ্ধ পরবর্তী খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের প্রসারের পথ তৈরি করে।
শক্তিকেন্দ্রের পরিবর্তন ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল ইউরোপের প্রধান শক্তিশালী দেশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। ফলে তাদের পূর্বের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং রাশিয়া ও আমেরিকা বিশ্বের দুই শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা ঃ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের 'চোদ্দ দফা নীতি'র ওপর ভিত্তি করে 'জাতিসংঘ' বা 'লিগ অব নেশনস' নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।
সামাজিক পরিবর্তন ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অগণিত যুবকের মৃত্যুর ফলে শিল্প ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাজে প্রচুর মেয়ে নিযুক্ত হয়। ফলে মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। এসময় শ্রমিকশ্রেণিরও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।