শিল্প বিপ্লবের ফলাফল / ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলাফল -
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং তারপর ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্প বিপ্লবের প্রসার ঘটে। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপীয় অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নিন্মে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব তথা শিল্প বিপ্লবের ফলাফল আলোচনা করা হল -
শিল্প ও অর্থনীতির বিকাশ ঃ শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি দ্রুত শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। শিল্পোৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় ফলে বাণিজ্যের অগ্রগতি ঘটে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
ফ্যাক্টরি প্রথার উদ্ভব ঃ শিল্প বিপ্লবের ফলে শহরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করে বহু শিল্প কারখানা বা ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়। এইভাবে শিল্প ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরি প্রথার উদ্ভব ঘটে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঃ ধনী শিল্পপতিরা তাদের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি করত। এরফলে বিপুল পরিমাণ পুঁজি তাদের হস্তগত হয় এবং তারা হয়ে ওঠে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি। ধীরে ধীরে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা এইসব পুঁজিপতিদের হাতে চলে আসে এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে।
মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঃ শিল্প বিপ্লবের ফলে মুনাফা হস্তগত হওয়ার ফলে সমাজে একদিকে যেমন পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে অন্যদিকে তেমনই চালচুলোহীন শোষিত শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
শ্রমিকদের শোষণ ঃ সামান্য মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকরা দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কলকারখানাগুলিতে কাজ করতে বাধ্য হত। ফলে তাদের জীবন অভাব অনটনে চলত। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্টি হওয়া মালিক ও শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কার্ল মার্কস বলেছেন, সূর্যালোকিত দিনে মাঝে শ্রমিকদের জীবন ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
মালিক শ্রেণির আধিপত্য ঃ শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত অভিজাত এবং ভূস্বামীরা দেশের একচেটিয়া রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করত। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ জমা হলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য স্থাপিত হয়।
উপনিবেশ স্থাপন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঃ শিল্প বিপ্লবের কারখানাগুলিতে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং শিল্পোৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বাজার দখলের প্রয়োজন হয়। এই কারণে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। উপনিবেশের সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে তা দখলের জন্য ইউরোপের শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
গ্রাম্য জীবনের অবক্ষয় ঃ শিল্প বিপ্লবের পর গ্রামের বহু মানুষ নগদ বেতনে কাজের আশায় গ্রাম থেকে শহরের শিল্প কারখানাগুলির উদ্দেশ্যে চলে আসতে থাকে। ফলে গ্রাম্য জীবনে অবক্ষয় শুরু হয়। এরফলে প্রাণচঞ্চল গ্রামগুলি হতশ্রী হয়ে পড়তে থাকে এবং নগর জীবনের প্রসার দ্রুত হারে ঘটতে থাকে।
সামাজিক অস্থিরতা ঃ শিল্প বিপ্লবের ফলে গ্রামের কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংসের দিকে এগোতে থাকে। আবার কলকারখানার মালিকরা বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের কাজ থেকে বের করে দিলে সেই সব শ্রমিকদের জীবনে নেমে আসত ভয়ঙ্কর দুর্দশা। এই অবস্থায় শ্রমিকরা কারখানার যন্ত্রগুলিকে তাদের শত্রু মনে করে সেগুলিকে ভাঙার জন্য দাঙ্গা শুরু করত। এভাবেই ইংল্যান্ডে লুডাইট দাঙ্গার সৃষ্টি হয়।
শ্রমিক আন্দোলন ঃ শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিকরা বিভিন্ন ভাবে অবিচার ও শোষণের স্বীকার হতে থাকে। ধীরে ধীরে শ্রমিকরা উপলব্ধি করে যে সাধারণ ভাবে তারা শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। তাই মাঝে মাঝেই শ্রমিকরা কারখানার মালিক এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ত।
মূল্যায়ন ঃ শার্ল ফুরিয়ের, সাঁ সিমোঁ, রবার্ট ওয়েন প্রমুখ সমাজতন্ত্রবিদরা শোষিত শ্রমিক শ্রেণিকে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচার করে বলেন যে, শোষণ থেকে মুক্তির পথ হল সমাজতন্ত্র। কার্ল মার্কস শিল্পোৎপাদনে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির সমান অধিকার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের দাবি করেছেন। এইভাবে ধীরে ধীরে ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন ঃ