প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আজ আমি তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করব "ভার্সাই সন্ধির বা ভার্সাই চুক্তির শর্ত বা শর্তাবলি আলোচনা করো" - এই প্রশ্নটি।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল পর্যন্ত সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির লড়াই। এই যুদ্ধে অক্ষশক্তির প্রধান রাষ্ট্র জার্মানির পরাজয় ঘটে। এরফলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানির ওপর ভার্সাই সন্ধি চাপিয়ে দেয়। নিন্মে ভার্সাই সন্ধির শর্ত গুলি আলোচনা করা হল -
ভার্সাই সন্ধির ভৌগলিক শর্ত ঃ ভার্সাই সন্ধির ভৌগলিক শর্ত গুলি হল -
(i) জার্মানি ফ্রান্সকে আলসাস ও লোরেইন অঞ্চল দুটি ছেড়ে দেবে।
(ii) জার্মানি বেলজিয়ামকে ইউপেন, ম্যালমেডি, মরেসনেট অঞ্চল ছেড়ে দেবে।
(iii) জার্মানি লিথুয়ানিয়াকে মেমেল বন্দর ছেড়ে দেবে।
(iv) ডেনমার্ককে শ্লেজভিগ অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জার্মানি।
(v) জার্মানির পূর্বদিকে স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন করা হয়।
(vi) জার্মানি পোল্যান্ডকে পোজেন এবং পশ্চিম প্রাশিয়া ছেড়ে দেয়।
(vii) উত্তর সাইলেশিয়া এবং পূর্ব প্রাশিয়া গণভোটের মাধ্যমে পোল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে জার্মানিকে সম্মতি প্রদান করতে হয়।
(viii) সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য জার্মানির ভিতর দিয়ে পোল্যান্ড 'পোলিশ করিডর' নামে রাস্তাটি জার্মানির কাছ থেকে ব্যবহারের অনুমতি পায়।
(ix) জার্মানির ডানজিগ বন্দরকে উন্মুক্ত বন্দর হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
(x) জার্মানি তার বিশেষ উপনিবেশ এবং বিশেষ সুবিধাযুক্ত অঞ্চল গুলি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
(xi) জার্মানি যাতে পশ্চিম দিকের ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য জার্মানির পশ্চিম সীমান্তে একটি নিরাপত্তা বলয় গঠন করা হয়।
আরও পড়ুন ঃ
ভার্সাই সন্ধির সামরিক শর্ত ঃ ভার্সাই সন্ধির সামরিক শর্তের মাধ্যমে জার্মানির ভবিষ্যৎ শক্তিবৃদ্ধির সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয়। যেমন -
(i) জার্মানি স্থল, জল ও বিমানবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়।
(ii) জার্মানির হেলিগোল্যান্ডের নৌঘাঁটি ভেঙে দেওয়া হয়।
(iii) জার্মানির সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে ১ লক্ষ করা হয়।
(iv) জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করা হয়।
(v) সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান নিষিদ্ধ করা হয়।
(vi) রাইন নদীর পশ্চিম তীরের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে 'অসামরিক অঞ্চল' হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
(vii) জার্মানি সেনাপতিদের বরখাস্ত করা হয়।
(viii) জার্মানিতে কামান, ট্যাংক, বোমারু বিমান ইত্যাদি তৈরি করা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়।
(ix) রাইন নদীর পূর্ব তীরে জার্মানির ব্যয়ে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী ও একটি কমিশন মোতায়েন করা হয়।
ভার্সাই সন্ধির অর্থনৈতিক শর্ত ঃ জার্মানির অর্থনীতিকে পঙ্গু করার জন্য ভার্সাই সন্ধির দ্বারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন -
(i) জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করা হয় এবং ৬৬০ কোটি পাউন্ডের বিপুল ক্ষতিপূরণ জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
(ii) জার্মানির বেশিরভাগ বাণিজ্যপোত ফ্রান্সকে দিয়ে দেওয়া হয়। জার্মানির বেশিরভাগ যুদ্ধ জাহাজ ইংল্যান্ডকে দিয়ে দেওয়া হয়।
(iii) জার্মানির কয়লা সমৃদ্ধ সার অঞ্চলে ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের অধিকার কায়েম হয়।
(iv) জার্মানি ১০ বছরের জন্য বিশেষ ধরণের কয়লা, লোহা, খনিজ, রবার ইতালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গকে সরবরাহ করতে রাজি হয়।
(v) জার্মানির বাজারে মিত্রপক্ষ তাদের পণ্য বিক্রির অধিকার পায়।
(vi) জার্মানির কিছু জলপথ আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রনে আনা হয়।
আরও পড়ুন ঃ
ভার্সাই সন্ধির অন্যান্য শর্ত ঃ ভার্সাই সন্ধির অন্যান্য শর্তগুলি হল -
(i) জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করা হয় এবং তার বিচারের চেষ্টা করা হয়।
(ii) আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।
(iii) পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া ও যুগোস্লাভিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
মূল্যায়ন ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানিকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভার্সাই সন্ধি চাপিয়ে দেওয়া হয়। জার্মানিকে বিমান হামলার হুমকি দিয়ে এই সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। এই কারণে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভার্সাই সন্ধিকে 'জবরদস্তিমূলক সন্ধি' বলে অভিহিত করেছেন।