দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো

প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, আজ আমি তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করব ইতিহাসের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো" - এই প্রশ্নটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো -

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ভয়ানক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল মিত্রশক্তি ভুক্ত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া ও আমেরিকা এবং অপরদিকে ছিল অক্ষশক্তি ভুক্ত ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই দশকের মধ্যেই বিশ্বইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটি ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যায়। যেকোন ঘটনার পিছনেই কোন না কোন কারণ দায়ী থাকে, সেরকমই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পিছনেও কিছু কারণ ছিল। নিন্মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করা হল -

ত্রুটিপূর্ণ ভার্সাই সন্ধি ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত অক্ষশক্তির নেতৃত্বপ্রদানকারী দেশ জার্মানির উপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তীব্র বৈষম্যমূলক ভার্সাই সন্ধি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা -

(i) জার্মানির বিভিন্ন ভূখণ্ড, শিল্পাঞ্চল, খনি ও উপনিবেশগুলি মিত্রশক্তি কেড়ে নেয়।

(ii) জার্মানির সামরিক শক্তিকে হ্রাস করে এমন অবস্থা করা হয় যাতে সে ক্ষুদ্র বেলজিয়ামের চেয়েও দুর্বল হয়ে যায়। জার্মানি যাতে ভবিষ্যতে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ইউরোপে কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে তার দিকেও নজর দেওয়া হয়।

  (iii) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি জার্মানির ওপর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। জার্মানি প্রথম থেকেই এই একতরফা ভাবে চাপিয়ে দেওয়া চুক্তি ভেঙে ফেলার সুযোগ খুঁজতে থাকে।

ঔপনিবেশিক লড়াই ঃ বিংশ শতকের শুরুতে উপনিবেশ দখলের লড়াইয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ গুলি এগিয়ে ছিল। যার ফলে বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী দেশ যেমন ইতালি, জার্মানি, জাপান, প্রভৃতি দেশগুলি খুব বেশি উপনিবেশ দখল করার সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়। বৈষম্যমূলক ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির অধিকাংশ উপনিবেশগুলি কেড়ে নেওয়া হয় ফলে উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।

একনায়কতন্ত্রের উত্থান ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিশ্বের কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে যেমন - জার্মানির নাৎসিবাদী শাসক হিটলার, ইটালির ফ্যাসিবাদী শাসক মুসোলিনি, জাপানের শাসক তোজো প্রমূখ। তারা উগ্র সাম্রাজ্যবাদী ও যুদ্ধবাদী নীতি গ্রহণ করলে বিশ্বব্যাপী অশান্তির সৃষ্টি হয়।

জাতিসংঘের ব্যর্থতা ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু জাতিসংঘ বারবার তার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। যেমন -

(i) ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে নিলে জাতিসংঘ জাপানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

(ii) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালি অ্যাবিসিনিয়া দখল করে নিলে জাতিসংঘ এবারও তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।

(iii) জার্মানি জাতিসংঘ ত্যাগ করে একে একে রাইন ভূখণ্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দখল করে নিলে জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

শক্তিজোট ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই সমগ্র বিশ্ব পরস্পর বিরোধী দুটি সশস্ত্র শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা 'মিত্রশক্তি' এবং অন্যদিকে ছিল ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা 'অক্ষশক্তি'।

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা ঃ জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি জার্মানির অস্ত্রশক্তি হ্রাসে উদগ্রীব হয়ে পড়লেও তারা নিজেদের অস্ত্রশক্তি হ্রাস করতে রাজি ছিল না। জার্মানি নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার সুযোগ না পাওয়ায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ত্যাগ করে এবং নিজের ইচ্ছামত সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।

ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ ঃ ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি ক্রমাগত ভার্সাই সন্ধির ধারাগুলি লঙ্ঘন করে বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন নীতি প্রয়োগ করে। এই আগ্রাসন প্রতিরোধ না করে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে তোষণ করতে থাকে। কারণ ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি মনে করত, একমাত্র তোষণ নীতির মাধ্যমেই বৃহৎ যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু তোষণ নীতির ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তাদের আগ্রাসন আরো দীর্ঘতর করে তোলে।

প্রত্যক্ষ কারণ ঃ অবশেষে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি শাসক হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ৩ সেপ্টেম্বর ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।

মূল্যায়ন ঃ প্রায় ছ-বছর যুদ্ধ চলার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটে। যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানি সাফল্য লাভ করলেও ধীরে ধীরে তার শক্তি কমতে শুরু করে এবং অবশেষে ইতালি, জার্মানি, জাপান আত্মসমর্পণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।


আরও পড়ুন -


Post a Comment

Previous Post Next Post