জুলাই রাজতন্ত্র -
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবে বুরবোঁ রাজবংশের রাজা দশম চার্লসের অবসান ঘটে এবং অর্লিয়েন্সঁ বংশের রাজা লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেন। জুলাই বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই রাজতন্ত্র ফ্রান্সে 'জুলাই রাজতন্ত্র' নামে পরিচিত।
জুলাই রাজতন্ত্রের পতন -
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের ফলে জুলাই রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলেও ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। এরপর ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নিন্মে জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলি তুলে ধরা হল -
বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্য ঃ জুলাই রাজতন্ত্রের সময়কালে ফ্রান্সে বুর্জোয়াদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফ্রান্সের পার্লামেন্টেও বুর্জোয়াদের প্রাধান্য ছিল। এই সময় তারাই ভোটাধিকার পেয়েছিলেন যাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এর ফলে এই রাজতন্ত্রের প্রতি দেশের সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ক্ষুব্ধ হয়।
শ্রমিকদের ক্ষোভ ঃ ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব শুরু হতে চাইলে শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। জুলাই রাজতন্ত্রের আমলে ফরাসি শ্রমিকরা চরম দুর্দশার মধ্যে জীবনযাপন করত। তারা প্রচুর সময় ধরে কাজ করত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত এবং পরিবর্তে পেত সামান্য মজুরি। এইভাবে শ্রমিকরা অন্যায়ের শিকার হয়, কিন্তু লুই ফিলিপ শ্রমিকদের কল্যাণে কোন নজর দেননি।
জনসমর্থনের অভাব ঃ জুলাই রাজতন্ত্রের সময়কালে ফ্রান্সের কোন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের সমর্থন লুই ফিলিপের সরকারের প্রতি ছিল না। রাজতন্ত্রের সমর্থকরা মনে করতেন যে, ফ্রান্সের সিংহাসনে লুই ফিলিপের কোন বৈধ অধিকার ছিল না। তাছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ অনুগামীদের ফরাসি সিংহাসনে বসাতে চাইত।
ভোটাধিকারে বঞ্চনা ঃ জুলাই রাজতন্ত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার প্রদান করে। এরফলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া ভোট গ্রহণে চলতে থাকে চরম দুর্নীতি।
বিদেশনীতিতে ব্যর্থতা ঃ লুই ফিলিপের বিদেশনীতি ছিল দুর্বল, নিষ্ক্রিয় ও ব্যর্থ প্রকৃতির। ফ্রান্সের বাইরে বিভিন্ন দেশে ভৌগলিক সম্প্রসারণের সুযোগ থাকলেও লুই ফিলিপ শান্তিবাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ইউরোপের যুদ্ধ, পোল্যান্ড ও ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রভৃতি থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। এর ফলে ফ্রান্সবাসী হতাশ হয়েছিলেন।
আর্থিক সংকট ঃ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ফ্রান্স তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হতে শুরু করে। দেশে খরা, শস্যহানি, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।
প্রত্যক্ষ কারণ ঃ ফ্রান্সের এমন দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে লুই ফিলিপ ও তাঁর মন্ত্রী গিজো প্রগতিশীল দাবিদাওয়া অগ্রাহ্য করেন। ফলে সাধারন মানুষ আন্দোলন শুরু করে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গিজোর বাসভবনের সামনে রক্ষীদের গুলিতে ২৩ জন বিক্ষোভকারী নিহত হলে সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে লুই ফিলিপ সিংহাসন ত্যাগ করেন। এরফলে জুলাই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
মূল্যায়ন ঃ লুই ফিলিপের শাসনকাল অর্থাৎ জুলাই রাজতন্ত্রের স্বরূপ একেবারেই স্পষ্ট ছিল না। কারণ লুই ফিলিপের সরকার প্রকৃত রাজতন্ত্র ছিন না। আর না ছিল প্রজাতন্ত্র আর না ছিল কোন প্রকৃত সাম্রাজ্য। তাই এমন অস্পষ্ট সরকারের পতন ছিল নিশ্চিত।
আরও পড়ুন ঃ