ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী "সত্তর বৎসর" -এর গুরুত্ব -
বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি হল সত্তর বৎসর। তাঁর এই গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রকাশকালে এটিতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলির বিবরণ দেওয়া হত। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিন্মে সত্তর বৎসরের গুরুত্ব আলোচনা করা হল -
জন্ম ও বংশ পরিচয় ঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের শ্রীহট্টের পৈল গ্রামে বিপিনচন্দ্র পালের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষ হিরন্য পাল পৈল গ্রামে প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন। বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে তারা এই অঞ্চলে এসেছিলেন।
শিক্ষাব্যবস্থা ঃ 'সত্তর বৎসর' থেকে তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেই সময় প্রত্যেক গ্রামে টোল ও ফারসি শেখার জন্য মাদ্রাসা ও মক্তব গড়ে উঠেছিল। সেই সময় বিভিন্ন নবাবি কাজের জন্য ফারসি জানা লোকের প্রয়োজন পড়ত, তাই বহু হিন্দু ছাত্র মাদ্রাসায় ফারসি শিখত। বিপিনচন্দ্র পালও ফারসি শেখার জন্য একজন মৌলবির কাছে ভরতি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রীহট্টের একটি ইংরজি বিদ্যালয়ে ভরতি হন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হয়েছিলেন।
সমকালীন সমাজে নারীশিক্ষা ঃ বিপিনচন্দ্র পালের 'সত্তর বৎসর' গ্রন্থে সেকালের মেয়েদের লেখাপড়ার রীতি ছিল না বলে জানা যায়। সমাজে কুসংস্কার ছিল যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয়ে যাবে। তবে উত্তরবঙ্গের দিকে এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মেয়েরা লেখাপড়া শিখত।
সমাজব্যবস্থা ঃ লেখকের সময়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দেখা যেত। গ্রাম্য সমাজে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করত। তাদের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। এই সময় ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল। 'সত্তর বৎসর' থেকে সমকালীন সমাজের রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, নাচ-গান প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা ঃ সমকালীন ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও সভাসমিতি সম্পর্কে এই গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক বিপিনচন্দ্র পাল। এই গ্রন্থ থেকে ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারতসভা এবং জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা কি ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা জানা যায়। তাছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজ, ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতার মানুষের জীবনযাত্রা প্রভৃতি সম্পর্কেও নানা তথ্য রয়েছে এই গ্রন্থে।
মূল্যায়ন ঃ বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও রাজনীতিবিদ। বিনয় কুমার সরকার লিখেছেন, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গবিপ্লবের জন্মদাতা ও নেতা ছিলেন বিপিনচন্দ্র। বিপ্লবী নেতা চিদাম্বরম বিপিনচন্দ্র পালকে স্বাধীনতা সিংহ বলেছেন। যদি 'সত্তর বৎসর' গ্রন্থে সত্তর বছরের ইতিহাস লেখা হত তাহলে আরও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যেত, তবে যে পরিমাণ তথ্য পাওয়া গেছে তা ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।