প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের গুরুত্ব -
প্রাচীন ভারতের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। ফলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের সাহায্য নিতে হয়। এর মধ্যে সাহিত্যগত উপাদান হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যগত উপাদানগুলিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - দেশীয় সাহিত্য ও বৈদেশিক সাহিত্য।
প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় সাহিত্য রচিত হয়েছিল। যেমন - ধর্মীয় সাহিত্য, জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতি শাস্ত্র, আঞ্চলিক ইতিহাস প্রভৃতি। এগুলি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বৈদিক সাহিত্য ঃ প্রাচীন ভারতের প্রধান উপাদান চারটি বেদ - ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব। বেদকে কেন্দ্র করে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। যেমন - ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, সংহিতা ও উপনিষদ। এই সব গ্রন্থ থেকে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক যুগের পরিচয় পাওয়া যায়।
মহাকাব্য ও পুরাণ ঃ বৈদিক সাহিত্যের পর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্য। এই দুটি গ্রন্থ থেকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও রাজাদের নাম, আর্য-অনার্য সংঘাতের ইতিহাস প্রভৃতি জানা যায়। তেমনি সমাজ জীবন, সংস্কৃতি ও দার্শনিক তত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় এই মহাকাব্যে বর্ণিত হয়েছে।
মহাকাব্যের পরে আসে পুরাণ। ভারতে আঠারোটি পুরাণ রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, বায়ুপুরাণ প্রভৃতি। এগুলি থেকে অসংখ্য রাজার নাম, বংশতালিকা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
স্মৃতিশাস্ত্র ঃ প্রাচীন ভারতে বহু স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। যেমন - মনুস্মৃতি, কাত্যায়নস্মৃতি, নারদস্মৃতি প্রভৃতি। এই সমস্ত গ্রন্থে বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়কালের সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্মীয় জীবন প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ ঃ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান হলো বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ। বৌদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ত্রিপিটক, জাতক, মহাবংশ, দীপবংশ প্রভৃতি। তেমনি জৈন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দ্বাদশ অঙ্গ, জৈন ভাগবতিী সূত্র, প্রবন্ধ চিন্তামণি (মেরুতুঙ্গ-এর রচিত) প্রভৃতি গ্রন্থ। এইসব গ্রন্থ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়।
পতঞ্জলির মহাভাষ্য, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে মোর্য-পরবর্তী যুগের কথা জানা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থান মৌর্য প্রশাসন সম্পর্কে বিভিন্ন উপাদান মিলে
জীবনীগ্রন্থ ঃ গুপ্ত যুগে প্রাচীন ভারতে বহু জীবনী গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বানভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থটি অন্যতম। এই গ্রন্থে হর্ষবর্ধনের দিগবিজয়, শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধ এবং হর্ষবর্ধনের জনকল্যাণকামী কাজের বিবরণ আছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত গ্রন্থে একদিকে অযোধ্যাপ্রতি রামচন্দ্র এবং অন্যদিকে পাল রাজা রামপালের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আবার বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেব চরিত, বাকপতিরাজের গৌড়বাহ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন রাজাদের বিবরণ পাওয়া যায়।
আঞ্চলিক ইতিহাস ঃ প্রাচীন ভারতের আঞ্চলিক ইতিহাসের মধ্যে প্রথমেই কলহনের রাজতরঙ্গিনীর কথা বলতে হয়। এই গ্রন্থে কলহন প্রথম নিরপেক্ষভাবে কাশ্মীরের রাজাদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। চাচনামা গ্রন্থে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। তামিল গ্রন্থ নন্দী কমলবকম থেকে পল্লব রাজা তৃতীয় নন্দীবর্মনের রাজ্যজয়ের কাহিনী জানা যায়। এছাড়া সোমেশ্বরের রাসমালা ও কীর্তি কৌমুদী থেকে গুজরাটের ইতিহাসের তথ্য জানা যায়।
সংস্কৃত সাহিত্য ঃ উপরোক্ত গ্রন্থাদি ছাড়াও প্রাচীন ভারতে অসংখ্য উন্নতমানের সংস্কৃত সাহিত্য রচিত হয়েছিল। এগুলি থেকে সরাসরি রাজনৈতিক ইতিহাস না পাওয়া গেলেও সমকালীন সমাজ জীবন ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় - কালিদাসের মেঘদূতম্, রঘুবংশম্, কুমারসম্ভবম্ প্রভৃতি গ্রন্থ ; বিশাখ দত্তের মুদ্রারাক্ষস ; হর্ষবর্ধনের নাগানন্দ, রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা ; জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সীমাবদ্ধতা ঃ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যগত তথ্যের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। অধিকাংশ গ্রন্থ রাজাদের আর্থিক আনুকূল্যে রচিত হয়েছিল। ফলে রচনাকারগণ অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব ঘটনার পরিবর্তে অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন। এইসব তথ্যকে বাদ দিয়ে ইতিহাস রচনা করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন গল্প ও কাহিনী বিভিন্ন গ্রন্থের মূল বিষয় হওয়ায় সেগুলিকেও ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বাদ দিতে হবে।
মূল্যায়ন ঃ দেশীয় সাহিত্যের কিছু ত্রুটি থাকলেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগের বর্ণনা, সাহিত্য থেকেই সংগ্রহ করা হয়। আর সঠিক তথ্য জানার জন্য অন্যান্য উপাদানের মাধ্যমে দেশীয় সাহিত্যের তথ্য যাচাই করা অবশ্যই প্রয়োজন।
আরও পড়ুন ঃ
১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মুদ্রা, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের গুরুত্ব