প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় লিপির গুরুত্ব / প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে লিপির গুরুত্ব -
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে লিপি হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাচীন যুগের রাজা-মহারাজা, জমিদার বা ভূমিদাতারা বিখ্যাত ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সোনা, রুপা, তামা প্রভৃতি ধাতুর উপর পালি, প্রাকৃত, ব্রাহ্মী, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষায় লিপি খোদাই করতেন। উদাহরণস্বরূপ, কোন রাজার সিংহাসনে আরোহন, ধর্মপ্রচার, রাজ্যজয় প্রভৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য লিপি খোদাই করা হতো। লিপিগুলি বিভিন্ন ধাতু, পাথর প্রভৃতির ওপর খোদাই করা হতো বলে এগুলি দীর্ঘকাল অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকতো। লিপিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - ভারতীয় বা দেশীয় লিপি এবং বিদেশী লিপি।
দেশীয় লিপি ঃ দেশীয় লিপি হিসেবে প্রথমে আসে সিন্ধু সভ্যতার লিপি। কিন্তু এই লিপির পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি। মৌর্য যুগের সূচনাকালে সোহগর তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ লিপি হল সম্রাট অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস প্রিন্সেপ অশোকের লিপির পাঠোদ্ধার করেন। এই লিপিগুলি থেকে মৌর্য যুগের ইতিহাস, সম্রাট অশোকের ব্যক্তিত্ব, ধর্মনীতি, জনকল্যাণকামী কার্যাবলী প্রভৃতির পরিচয় মেলে। অশোকের পরবর্তী যুগের লিপিগুলিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা - প্রশস্তি এবং ভূমিদানলিপি।
প্রশস্তি ঃ এক্ষেত্রে প্রথমে গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তির কথা বলতে হয়। হরিষেনের লেখা এই প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের মনোনয়ন। তাঁর উত্তর ও দক্ষিণ ভারত অভিযান এবং তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কথা জানা যায়। সাতবাহন বংশের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে নাসিক প্রশস্তি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশস্তি থেকে গৌতমীপুত্র সাতকর্নির দিগবিজয় ও অন্যান্য কার্যাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়। আইহোল প্রশস্তি থেকে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর বিজয় কাহিনী সম্পর্কে জানা যায়। রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপি থেকে তাঁর সাম্রাজ্যবিস্তার, জনকল্যাণমূলক কাজ প্রভৃতির পরিচয় মেলে। হস্তিগুম্ফা লিপি থেকে কলিঙ্গরাজ খারবেলের ইতিহাস জানা যায়। উমাপতি ধরের দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে সেন রাজা বিজয়সেনের সাম্রাজ্যবিস্তরের কাহিনী জানা যায়। এছাড়া প্রতিহার রাজা ভোজের গোয়ালিয়র লিপি, শশাঙ্কের গঞ্জাম লিপি, ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপি প্রভৃতি থেকে সংশ্লিষ্ট রাজাদের রাজ্যজয় এবং অন্যান্য কার্যাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়।
ভূমিদান লিপি ঃ প্রশস্তি ছাড়াও প্রাচীন ভারতে রাজা বা জমিদার শ্রেণী বহু ভূমিদান লিপি রচনা করেছিলেন। যেমন - বন্যগুপ্তের তিপেরা ভূমিদান লিপি, দ্রোণসিংহের মৈত্রক ভূমিধান লিপি প্রভৃতি। এগুলি থেকে ভূমির পরিমাণ, দানের উদ্দেশ্য ছাড়াও ভূমি বন্দোবস্ত এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস সংক্রান্ত বহু তথ্য মেলে।
বিদেশী লিপি ঃ দেশীয় লিপি ছাড়া ভারতের বাইরে প্রাপ্ত বিদেশী লিপি থেকেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। যেমন - মধ্য এশিয়ায়* প্রাপ্ত বোঘাজকোই লিপি থেকে আর্য দেবতাদের নাম এবং আর্যদের ভারতে আগমন সংক্রান্ত তথ্য মেলে। এছাড়া ইরানের পার্সেপোলিস, নকস্-ই-রুস্তম প্রভৃতি স্থান থেকে প্রাপ্ত লিপিগুলি উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
সীমাবদ্ধতা ঃ লিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা অধিকাংশ লিপি রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল, ফলে বহু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাই লিপিকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে এই ত্রুটির প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন।
মূল্যায়ন ঃ উপরোক্ত ত্রুটি সত্বেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে লিপি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ লিপি স্থায়ী ধাতুর উপর তৈরি হওয়ায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাছাড়া একবার লিপি তৈরি হওয়ার পর তা আর পরিবর্তন করা যায়নি। তেমনি লিপিতে বহু রাজার নাম, সন-তারিখ সহ বিভিন্ন বিবরণ দেওয়া হয়েছে যা অন্য কোন উপাদানে পাওয়া যায় না। এজন্য ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লিপির গুরুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা সর্বাধিক।
আরও পড়ুন ঃ