ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগ বা প্রস্তর যুগ সম্পর্কে আলোচনা করো

ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগ বা প্রস্তর যুগ -

পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সূচনাকাল থেকে লিখিত বা ইতিহাসের প্রামাণ্য বিষয় হাতে পাওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত যুগকে 'প্রাগৈতিহাসিক যুগ' বলে। এই যুগটি প্রাচীন যুগের প্রথম পর্যায়। পল তুর্নাল প্রথম 'প্রাগৈতিহাসিক' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও হাতিয়ার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে প্রাগৈতিহাসিক যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - প্রাচীন প্রস্তর যুগ, মধ্যপ্রস্তর যুগ এবং নব্য প্রস্তর যুগ। 

প্রাচীন প্রস্তর যুগ ঃ প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম পর্যায় হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ। এই যুগের সময়কাল ছিল আনুমানিক ২৬ লক্ষ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রায় ১০০০০/৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। যুগের গুহামানবরা সভ্যতার একেবারে প্রাথমিক স্তরে বিরাজ করত। তারা বৃহৎ আকারের অমসৃণ পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল হাতকুঠার। এযুগের মানুষ গুহায় বা গাছের ওপর বসবাস করত এবং যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। তারা পাথরের হাতিয়ার দিয়ে দলবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন পশু শিকার করত। তারা কাঁচা মাংস ও বনের বিভিন্ন ধরনের ফল খেত। এযুগের মানুষ আগুনের ব্যবহার জানতো না। 

     ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাঞ্জাবের সোয়ান নদীর উপত্যকার সোয়ান সংস্কৃতি এবং মাদ্রাজ অঞ্চলের মাদ্রাজ সংস্কৃতি। ভারতের এই অঞ্চলগুলির আদিম মানুষেরা পাথরের তৈরি হাতকুঠার ছাড়াও ছুরি, বর্শা প্রভৃতি হাতিয়ার ব্যবহার করত। তারা মৃতদেহকে কবর দিত। প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষদের আকৃতি ছিল অনেকটা প্রায়-মানুষের মত। 

মধ্য প্রস্তর যুগ ঃ প্রাচীন প্রস্তর যুগের অবসানের পর মধ্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়েছিল। আনুমানিক ৮০০০ - ১০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই যুগের সূচনা ঘটে। এযুগে পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। যেমন - জলস্তর বৃদ্ধি, মরুভূমি ও বনভূমি সৃষ্টি। পরিবেশের এই পরিবর্তনের ফলে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। অবশ্য মধ্য প্রস্তর যুগের প্রথম দিকে মানুষ প্রাচীন প্রস্তর যুগের মতো গুহাবাসী যাযাবর, গুহাবাসী ও খাদ্য সংগ্রাহকের জীবন যাপন করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হাতিয়ারের ব্যবহার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসে। ছোট ছোট পাথরের তৈরি হাতিয়ারের ব্যবহার করা শুরু হয়, হাতিয়ারগুলি আগের চাইতে অনেক উন্নত হয়।

     ভারতে মধ্য প্রস্তর যুগ ঃ মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা, গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই যুগের শেষের দিকে মানুষ খাদ্য উৎপাদন শুরু করে দেয়। গোরু, কুকুর, ছাগল প্রভৃতি প্রাণীকে পোষ মানানো শুরু হয় এবং কৃষিকাজের সূচনা ঘটে। পাশাপাশি এই সময় মৃৎশিল্প, ছোট ছোট নৌকা তৈরি প্রভৃতি এযুগে দেখা যায়।

নব্য প্রস্তর যুগ ঃ মধ্যপ্রস্তর যুগের পরবর্তীকালে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়েছিল। এ যুগের হাতিয়ারগুলি ছিল ধারালো ও মসৃণ। এ সময় মাটি খোঁড়ার যন্ত্র, কাস্তে, হামানদিস্তা প্রভৃতি তৈরি হতো, ফলে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এযুগে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। ধান, গম প্রভৃতি কৃষি উৎপাদন, গরু, মহিষ প্রভৃতি পশুকে পোষ মানানো, মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের পাত্র নির্মাণ প্রভৃতি নব্য প্রস্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুগের মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে এবং মাটি ও কাঠের সাহায্যে ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর তৈরি করতে থাকে।

     ভারতে নব্য প্রস্তর যুগ ঃ ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের বিকাশ ঘটেছিল। সিন্ধুপ্রদেশ ও বেলুচিস্তান ছিল নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। মেহেরগড়, কিলিগুল মহম্মদ, বুরজাহোম, চিরান্দ, ব্রহ্মগিরি প্রভৃতি অঞ্চলে নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ যুগের মানুষ কুমোরের চাক ও আগুনের ব্যবহার শুরু করে ফলে সভ্যতার আরো উন্নতি ঘটে। এসময় যাতায়াতের জন্য নৌকা আবিষ্কৃত হয়। তেমনি পাথরের সঙ্গে মানুষ তামার ব্যবহার শুরু করে।

মূল্যায়ন ঃ উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ পাথরের হাতিয়ারের সাহায্যে আদিম অরণ্যচারী জীবন অতিবাহিত করত। এরপর ধীরে ধীরে মানুষ উন্নত পাথরের অস্ত্র ব্যবহার, মৃৎশিল্প, কৃষির উন্নতি, আগুনের ব্যবহার প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আধুনিক জীবনযাত্রার পথে এগিয়ে যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post