প্রশ্ন ঃ শিক্ষা বিজ্ঞান থেকে সমস্ত বিষয়গুচ্ছের উদ্ভব - ব্যাখ্যা করুন। (Explain the emergence of various discipline from education.)
অথবা,
প্রশ্ন ঃ ব্যাখ্যা করুন - শিক্ষা থেকে বিভিন্ন বিষয়গুচ্ছের উদ্ভব। (Explain - Emergence of various discipline from education.)
অথবা,
প্রশ্ন ঃ শিক্ষা বিষয় থেকে সমস্ত বিষয়গুচ্ছের উৎসের ব্যাখ্যা করুন (Explain emergence of various discipline from education.)
উত্তর ঃ
মনুষ্য জাতির মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য সত্ত্বার উপস্থিতি রয়েছে। এই দুটি সত্ত্বা হল জৈবিক সত্ত্বা ও বৌদ্ধিক সত্ত্বা। জৈবিক সত্ত্বার তাগিদে মানুষ যেমন তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে নিজেকে রক্ষা করে তেমনি বৌদ্ধিক সত্ত্বার তাগিদে তার বুদ্ধিবৃত্তি বা প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে মনের তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেছে। মানুষ তার ব্যবহারিক জীবনকে বিকশিত ও রক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। 'শিক্ষা' হচ্ছে তার জীবনের অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী। কিন্তু পূর্বে এই শিক্ষা ছিল প্রথাহীন। ধীরে ধীরে মানুষ উপলব্ধি করেছে প্রথাহীন শিক্ষা বা পরোক্ষ শিক্ষার অনেক অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যেমন -
প্রথমত, পরোক্ষ শিক্ষার কিছু জটিল অংশ রপ্ত করতে হলে দরকার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ, যা কেবল প্রত্যক্ষশিক্ষায় সম্ভব।
দ্বিতীয়, পরোক্ষ শিক্ষার পরিধি যখন অনেকখানি বিস্তৃত নয়, তখন তা বিশেষভাবে অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত ব্যক্তির নিকট থেকে অর্জন করার প্রয়োজন পড়ে।
তৃতীয়, শিক্ষা যখন ক্রমশ বিশেষধর্মী হতে থাকে তখন তা পরোক্ষভাবে অর্জন সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রত্যক্ষ শিক্ষার।
চতুর্থ, সভ্যতার একটি পর্যায়ে যখন মানুষ লিপির আবিষ্কার করতে সমর্থ হল তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যক্ষ শিক্ষা মানুষের জীবনে অনিবার্য হয়ে পড়ল।
এইভাবে পরোক্ষ শিক্ষার অসুবিধাগুলি দূর করে প্রত্যক্ষ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার শিক্ষার গভীরতা, ব্যাপকতা এবং প্রয়োগধর্মিতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়ে থাকে। আর এইভাবে প্রত্যক্ষ শিক্ষার শিক্ষায় বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং ব্যাপকতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা স্বতন্ত্র বিষয়ের উদ্ভব ঘটতে শুরু করে।
প্রাচীন মানব সভ্যতায় প্রথম বিষয় হিসাবে স্বীকৃতি পায় শিক্ষা। এই শিক্ষা প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে উভয় জায়গাতেই স্থান পেয়েছে। এরপর প্রথাগত শিক্ষার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে 'দর্শন'। 'বুদ্ধি' বা 'প্রজ্ঞা'র স্বাভাবিক ধর্ম অনুসারে বিশ্ব প্রকৃতিকে নিয়ে অজস্র প্রশ্ন মানুষের মনে উদয় হয়েছে। এই বিশ্ব প্রকৃতির জড় ও চেতন এবং পরম সত্ত্বার স্বরূপ তার কাছে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে। মানুষ তার নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে প্রকৃতির সমস্ত কিছুকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। যুক্তির পর যুক্তিকে উপস্থাপন করে মানুষ তার সামগ্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের এই জানার আগ্রহ জন্ম দিয়েছে 'দর্শন'কে।
জীবন ও জগতের প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং তার মূল্যায়ন করে যে শাস্ত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তা হল 'দর্শন'। এরপর সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে দর্শন হয়ে উঠেছে একটি স্বতন্ত্র বিষয়। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় দেখা যায় যে, প্রথাগত শিক্ষায় একমাত্র দর্শন ছিল স্বতন্ত্র বিষয়। প্রকৃত অর্থে দর্শনেরও সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা থেকে। এরপর সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দর্শন থেকে পৃথকভাবে স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ভাষা, সাহিত্য এবং গণিত শাস্ত্র।
পরবর্তীকালে দর্শন নামক স্বতন্ত্র বিষয়টি দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত, যথা - প্রাকৃতিক দর্শন এবং নৈতিক দর্শন। প্রাকৃতিক দর্শন ক্রমশ পরিচিত হয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নামে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর গভীরতা ও জ্ঞানের প্রসারতা যখন বৃদ্ধি পায় তখন অনেকগুলি স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে তা আলাদা হয়ে যেতে থাকে। ক্রমে এই বিজ্ঞান থেকে উৎপত্তিলাভ করে রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, ভূগোল বা ভূবিদ্যা, যা পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে 'নৃ-বিজ্ঞান' নামক বিষয়টি আত্মপ্রকাশ করে।
অন্যদিকে, নৈতিক দর্শন নামক স্বতন্ত্র বিষয়টি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস ও মনোবিদ্যা নামক বিষয়গুলি। ধীরে ধীরে এই সমস্ত বিষয়গুলির প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র বিষয়ের মর্যাদা লাভ করে।