গুপ্ত যুগের ভূমিদান ব্যবস্থা -
গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম দিক ছিল ভূমিদান ব্যবস্থা, যার মধ্যে দিয়ে জমি ক্রয়-বিক্রয়, কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ও সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে গুপ্ত যুগের ভূমিদান ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল -
জমির মালিকানা ঃ গুপ্ত যুগে রাজার হাতেই জমির মালিকানা ছিল। রাজা জমি দান করলেও জমিতে রাজার কর আরোপের অধিকার ছিল। তেমনই জমি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য রাজার অনুমতি নিতে হত। গুপ্ত যুগে রাজারা বিভিন্ন সময়ে ব্রাহ্মন এবং ধর্মস্থান বা মন্দিরকে বহু নিষ্কর জমি দান করতেন। গুপ্ত যুগে এই নিষ্কর জমিদানের ব্যবস্থাকে অগ্রহার প্রথা বলে।
গুপ্ত যুগে ভূমিদান প্রথার বৈশিষ্ট্য ঃ
১. গুপ্ত যুগে পুণ্য লাভের আশায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, কর্মচারী, বণিক এবং অনেক সময়ে রাজারা জমি দান করতেন। জমি হস্তান্তরের সময় দলিলে বিভিন্ন শর্তের উল্লেখ থাকত। যেমন - নীতিধর্ম, অক্ষয় নীতিধর্ম প্রভৃতি।
২. মৌর্য যুগের সময় থেকে কিছু কিছু নির্দিষ্ট কিছু বছরের জন্য জমি প্রদান করা হলেও তা চিরস্থায়ী ছিল না কিন্তু গুপ্ত যুগে যেসব জমি দান করা হত সেগুলি ছিল চিরস্থায়ী ভিত্তিতে।
৩. অগ্রহার ব্যবস্থা অনুসারে জমির প্রাপক বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগদখল করার অধিকার লাভ করে।
৪. দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত গ্রাম বা জমিগুলির রাজস্ব আদায় এবন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল গ্রহীতা ব্রাহ্মন বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে।
ভূমিদান ব্যবস্থার প্রভাব ঃ
গুপ্ত রাজাদের অগ্রহার ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিদানের ফলে সমাজে কৃষি ও ভূমিব্যবস্থার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। যেমন -
১. ইতিপূর্বে জমির মালিক ছিলেন রাজা। কিন্তু নতুন ভূমিদান ব্যবস্থার ফলে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে নতুন ভূস্বামী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
২. জমি লাভকারী ব্যক্তিরা বংশানুক্রমিকভাবে নিজের প্রাপ্ত জমি বা গ্রামগুলিতে রাজস্ব আদায়, বিচারের কাজ প্রভৃতি চালানো শুরু করে। ফলে রাজার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং স্থানীয় স্তরে নতুন ভূস্বামী শ্রেণির অধিকার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৩. গুপ্ত যুগে ভূমিদান ব্যবস্থার ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে।
৪. অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে নতুন জমি প্রাপক শ্রেণি কৃষির উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে। তারা অনাবাদি জমিকে কৃষি জমিতে পরিণত করতে থাকে। ফলে এই সময় কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে।
৫. ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা মনে করেন যে, অগ্রহার ভূমিদান ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গুপ্ত যুগে ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে। রাজাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জমি লাভ করে গ্রামাঞ্চলে এক নতুন সামন্ত অভিজাত শ্রেণির জন্ম হয়। এরা গ্রামের সমস্ত ক্ষমতা ভোগ করত এবং কৃষকদের নানা ভাবে শোষণ করত।
মূল্যায়ন ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গুপ্ত যুগে ভূমিদান ব্যবস্থার ফলে একদিকে যেমন ধনী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে তেমনই কৃষক সমাজের ওপর শোষণ আর বৃদ্ধি পায়। এই ভাবে গুপ্ত যুগে ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে।